Search This Blog

Monday, June 13, 2011

ভোর

ভোর
অবিন সেন

কোনদিন ঘুমভেঙে দেখি জ্যোৎস্নার স্তব
কোনদিন ভোরবেলা,
গাছেরও ডানা আছে—তাও
শকুনের অবিশ্বাস
বৃহন্নলা কোন নদীর তীরে
ছায়া পালটে পালটে চিতা জ্বেলে দেয়—
অনিমেষ উষ্ণতায়,
গাছেরাও উড়ে উড়ে দিকহারা
শকুনের মতো—
জ্যোৎস্নাটিকে মৃত জেনে নিয়ে রাতের
জানালা খুলে দেয়—দেখি ধু ধু কোথাও
লালগড়, কোথাও নেতাইগ্রাম, যেন
অবিশ্বাস কোলে করে বসে—
ভোরের প্রথম পাখিটিকে শকুনের মতো দ্যাখে !

প্রসঙ্গ কবিতা

প্রসঙ্গ কবিতা
অবিন সেন
কবিতা কেন লিখি এ একটা জটিল ব্যাপার, আসলে এটা এখন ঘুম থেকে ওঠা বাহ্যে যাবার মতো--না করে পারি না, এর মধ্য কতটা শিল্প থাকে জানি না, অন্তত ঘুম থেকে ওঠার মধ্যে কি আর ক্রিয়েটিভিটি আছে ? সে তো এমনিই করে ফেলি, আসলে সেই একটি কথা, না করে পারি না! হ্যাঁ তার মধ্যে অনেক সময় অনেক ব্যথা থাকে, বেদনা থাকে....কষ্টের ফল বলেই কি শিল্প? ছেলেবেলায় আমি নাকি তিনদিন ছাড়া পটি করতুম সে এক বড় কষ্টের ছিল ! তার মধ্যেও কিছু শিল্প থাকা উচিত ? অন্তত কেউ সেটা সিনেমায় দেখালে সেটা শিল্প হয়ে যেত নিশ্চয়ই। তা হলে দেখা বা দেখাবার মাধ্যমটা হয়ে গেল শিল্প, তেমন কথার পর কথা সাজিয়ে যে কবিতা প্রাণ পেল সেটা শিল্প নয় , বরং তার ভঙ্গিটা শিল্প,আজের কথাই ধরা যাক অফিসে বসে মনে হল
to fly in the sky
to fly in the sky
২৭ বছর ধরে এমনি একটা বিষাধ
যাযাবরের মতো
কিংবা বেড়া....এটা কোন শিল্প হচ্ছে না, এটা নিজের সঙ্গে নিজের বাক্যালাপ, যেমন নদীর ধারে এক একা বেড়াই , অনায়াসে, কবিতাও বা কবিতা নয়।
তারপর অনেক্ষন আড্ডা দিয়ে, আবার মনে পড়ল
আগুনের মতো মোরগ ফুল-
দুপুরে জানালার বাইরে
বেড়ার ধারে.......................এবার মনে হচ্ছে এটা কবিটা , খাতা নিয়ে বসতে...সেই কোষ্ঠকাঠিন্য ব্যথা, পরের লাইনটা আর মনে আসে না, তার পর বউয়ের সঙ্গে ফোনে গল্প করে এসে মনে পড়ল..
জানালার বাইরে হাত বাড়ালেই
রোদের মতো আঙুলে লেগে যায়
ছিন্নমূল আবেগ....সে শাদা স্কুল বাড়ি
সে পুকুরে শ্যাওলা,..............এ গুলো এমনিই আসে, এ এমনিই অনুভবে আসে, এতে শিল্প আছে কি না জানি না...শুধু মনে পড়ে সুখে দুখে এ সব এমনিই আসে....এতে ভূগোল আছে, ইতিহাস আছে..বিজ্ঞান আছে...আছে তবে ,তাদের মতো করে আছে ।

আমাদের রোজনামচা, আমাদের খাওয়া , ঘুম, সংস্কৃতি সবারই শিল্পের কাছে টিকি বাঁধা আছে; আমরা এই যে রোজ রোজ একটু একটু করে খরচ হয়ে যাচ্ছি তাও শিল্প বইকি...তাহলে যে লোকটা পুকুরে জাল ফেলছে, জাল ফেলতে ফেলতে মাছের জন্য অপেক্ষা করছে আর যে লোকটা টেবিলে বসে ভাবছে " পটললালের মনে হয় তার মাথার ভিতর এক ব্যাঙ বাস করে" তারা শিল্পের নিরিখে পাশা পাশী কাছা কাছি হয়ে যায় যদিও আমরা শিল্পের সভায় সেই দ্বিতীয় জনকেই ডাকব কারণ সে সাহিত্যিক সে পৃথিবীর রঙ তুলি দিয়ে নিজের মতো করে শিল্পের উপর আরও কিছু সৃষ্টি করছে....তাই এ দু জন মানুষ কাছাকাছি হয়েও বোধহয় কাছাকাছি নয়..এক নৌকার মাঝিকে "আমার সোনার বাংলা " গাইতে দেখে সদ্য প্রয়াতা সুচিত্রা মিত্র কেঁদে ফেলে ছিলেন...বলে ছিলেন একবার যে তিনি নিজে কেন এতো আকুল হয়ে এ গান গাইতে পারেন না..এখানেও সেই অনায়াস রঙ রূপের বাইরে আরো সৃষ্টির খেলা আছে...সে শুধু জীবন যাপন নয়..আবার সে কিছু দেবার বা নেবার জন্যেও নয়, দেবার জন্যেই যদি হয় তবে তা নিজের কাছে...এখানে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়েকটি লাইন তুলে দিই "আমাদের সৃষ্টি করবার ভার যে স্বয়ং তিনি দিয়েছেন। তিনি যে নিজে সুন্দর হয়ে জগৎকে সুন্দর করে সাজিয়েছেন, এ নিয়ে তো মানুষ খুশি হয়ে চুপ করে থাকতে পারল না। সে বললে, ‘আমি ঐ সৃষ্টিতে আরও কিছু সৃষ্টি করব।’ শিল্পী কি করে। সে কেন শিল্প রচনা করে। বিধাতা বলেছেন, ‘আমি এই-যে উৎসবের লণ্ঠন সব আকাশে ঝুলিয়ে দিয়েছি, তুমি কি আলপনা আঁকবে না। আমার রোশনচৌকি তো বাজছেই, তোমার তম্বুরা, কি একতারাই নাহয়, তুমি বাজাবে না?’ সে বললে, ‘হাঁ বাজাব বৈকি।’ গায়কের গানে আর বিশ্বের প্রাণে যেমন মিলল
অমনি ঠিক গানটি হল। আমি গান সৃষ্টি করব বলে সেই গান তিনি শোনবার জন্যে আপনি এসেছেন। তিনি খুশি হয়েছেন; মানুষের মধ্যে তিনি যে আনন্দ দিয়েছেন, প্রেম দিয়েছেন, তা যে মিলল তাঁর সব আনন্দের সঙ্গে– এই দেখে তিনি খুশি। শিল্পী আমাদের মানুষের সভায় কি তার শিল্প দেখাতে এসেছে। সে যে তাঁরই সভায় তার শিল্প দেখাচ্ছে, তার গান শোনাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘বাঃ, এ যে দেখছি আমার সুর শিখেছে, তাতে আবার আধো আধো বাণী জুড়ে দিয়েছে– সেই বাণীর আধখানা ফোটে আধখানা ফোটে না।’ তাঁর সুরে সেই আধফোটা সুর মিলিয়েছি শুনে তিনি বললেন, ‘খুশি হয়েছি।’ এই-যে তার মুখের খুশি– না দেখতে পেলে সে শিল্পী নয়, সে কবি নয়, সে গায়ক নয়।যে মানুষের সভায় দাঁড়িয়ে মানুষ কবে জয়মাল্য দেবে এই অপেক্ষায় বসে আছে সে কিছুই নয়। কিন্তু, শিল্পী কেবলমাত্র রেখার সৌন্দর্য নিল, কবি সুর নিল, রস নিল। এরা কেউই সব নিতে পারল না। সব নিতে পারা যায় একমাত্র সমস্ত জীবন দিয়ে। তাঁরই জিনিস তাঁর সঙ্গে মিলে নিতে হবে। "
তাই বোধহয় পটললাল আর রবিবাবু এক হয়েও এক নন । কিন্তু পটললালের কথা যে ভাবছে সে তার রঙ তুলি নিয়ে পটললালকে নিজের মতো করে সাজাচ্ছে, সে সেটা অনায়াসেই তা করছে, সে ভাবছেনা সেটা আদৌ শিল্প হচ্ছে কি হচ্ছে না ! সে শুধু নিজের কাজটা করে যাচ্ছে....কারণ না করেও সে পারছে না...এই নিজেকে নিবেদন করা নিজের কাছে, এটাই তার নিয়তি।

হাতের লেখা খারাপ ছিল বলে বাবা-মা আমাকে ছবি আঁকার স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন, সেই আমার ছবির সাথে অন্য পরিচয়..গাছ, পাখি, ফুল আঁকতে আঁকতে একদিন দেখলুম গাছ ফুল পাখি দেখার ভঙ্গিটা কেমন বদলে গিয়েছে, আগে যে ছিল শুধু গাছ, পরে সে যেন গাছের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য কিছু , এ শুধু ছবির খাতা নিয়ে চিত্র চর্চা নয়, যে ছবিটা আঁকব বলে আঁকা হল না সে ছবিকে মনের মধ্যে নিয়ে খেলতে বসলুম....যে শুধু ছিল তালগাছ সে যেন হয়ে গেল
"তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে ।
মনে সাধ , কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
একেবারে উড়ে যায় ;
কোথা পাবে পাখা সে ?"
সেই আমার ছবির ভিতর দিয়ে কবিতার সঙ্গে পরিচয়। বলা যায় ছবিই একদিন আমায় হাত ধরে কবিতার কাছে নিয়ে এলো..আমি ছবি আঁকা ছেড়ে মনের ভিতর ছবি সাজাতে বসলুম...তারপর সেই ছবিই একদিন কথার রূপ পেল।তখন থেকেই ছবি লিখতে বসলুম, ছবি পড়তে বসলুম..আস্তে আস্তে আমার কবিতা পড়ার অভ্যাস তৈরি হল।যত দিন গেল কবিতার ছবিও পাল্টে পাল্টে যেতে লাগল...কখনো তা আমার চারপাশের ছবি যা আমার দৈনন্দিন জীবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে..যেমন ধরা যাক-"কুমোর-পাড়ার গোরুর গাড়ি —
বোঝাই-করা কলসি হাঁড়ি ।
গাড়ি চালায় বংশীবদন ,
সঙ্গে-যে যায় ভাগ্নে মদন ।
হাট বসেছে শুক্রবারে
বক্সী-গঞ্জে পদ্মাপারে ।
জিনিষপত্র জুটিয়ে এনে
গ্রামের মানুষ বেচে কেনে ।
উচ্ছে বেগুন পটল মূলো ,
বেতের বোনা ধামা কুলো ,
সর্ষে ছোলা ময়দা আটা ,
শীতের র‍্যাপার নক‍্‌শাকাটা ।"
এ ছবি চোখের সামনে চলচিত্তের মতো জেগে ওঠে। আর এক ধরনের ছবি আছে যাকে চারপাশে দেখি না, সে আমর চারপাশে নিবিড় হয়ে নেই...সে ছড়িয়ে আছে মনের ভিতর...মনের চশমা দিয়ে তাকে দেখতে হয়।"পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে চাওয়া নাটোরের বনলতা সেন"...পাখির নীড়ের মতো চোখ শুধু মনের ভিতরেই থাকে। সে জ্যোৎস্নার মতো আবছা আলো দেয়,সে নদীর মতো আলগোছে তীরটিকে মাখে,সে আমদের রোজকার নিয়মের বাইরে । সন্ধ্যার ভোঁ বাজলে আকুল মাঝির মতো বলে "পারে যাবে? পারে যাবে?"সেই অচেনা ছবির আত্মপ্রকাশই আসলে একরূপ কবিতা...আমার কবিতা ।

আমাদের পটললালের যখন অবসর থাকে তখন সে খবরের কাগজের ভালো ভালো পছন্দের খবরগুলি কেটে কেটে সাজিয়ে রাখে।নানা রঙ পেনসিল দিয়ে সেই খবরগুলিকে চিত্রিত করে, এ তার অবসরের বিলাস, ঠিক কবিতা লেখার মতো, নিজেকে ,নিজের মননকে নিজের মতো করে সাজানো! যেমন তেমন করে সাজানো নয়,সে সাজানোর মধ্যে মিশে থাকে আত্মিকতার সৌন্দর্য! কিন্তু পটললাল যখন অফিস যায়,তখন সব কিছুতেই তার ত্বরা, সে সময় তার খবরের সুন্দর তত্বের প্রয়োজন নেই, বাস্তব প্রয়োজনই সেখানে বড়, সেসব আত্মিকতার গুঞ্জনে পূর্ণ নয়, তার দেখার ভঙ্গি impersonal.
সভ্যতার সূচনায় যখন মানুষ তার খাওয়া, পরা, প্রভৃতি প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে উঠে ভাবতে শিখল,যখন তার অবসর সময় কে কোলে নিয়ে বসল, তখন সে ঈশ্বরের সৃষ্টির উপরেও নিজের মনের রঙ মেশাবার প্রয়োজন বোধ করল--তার কবিতার মাধ্যমে, গানের মাধ্যমে,চিত্রের মাধ্যমে! সে বাইরের বিশ্বকে বরন করে নিল বিশেষ রসের আতিথ্যে।"ফুল তার আপন রঙের গন্ধের বৈশিষ্ট্যদ্বারায় মৌমাছিকে নিমন্ত্রণ পাঠায়;সেই নিমন্ত্রণ লিপি মনোহর।কবির নিমন্ত্রণেও সেই মনোহারিতা ছিল।"সে মনোহারিতার শিল্পকর্ম ছিল মানুষের ব্যক্তিগত অভিরুচি ও চেতনার উপর।আসলে ভগবানের নানা সৃষ্টির ছলা কলায় যে মোহ খেলা করে সেই মোহকেই মানুষ মুখ্য বলে মনে করেছিল।তাই মানুষের তৈরি শিল্পে ছিল মোহের ছলা কলা, সে বাস্তবকে অস্বীকার করেনি কিন্তু তাকে গৌণ ভেবে তার উপর সজিয়ে ছিল ছন্দ সুর তালের আলো আঁধারি। কবিতাও ছিল তাই ছন্দের মালায় সাজানো।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন
" সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছন্দে বন্ধে ভাষায় ভঙ্গিতে মায়া বিস্তার ক’রে মোহ জন্মাবার চেষ্টা করেছি, এ কথা কবুল করতেই হবে। ইশারা-ইঙ্গিতে কিছু লুকোচুরি ছিল; লজ্জার যে-আবরণ সত্যের বিরুদ্ধ নয়, সত্যের আভরণ, সেটাকে ত্যাগ করতে পারি নি। তার ঈষৎ বাষ্পের ভিতর দিয়ে যে রঙিন আলো এসেছে সেই আলোতে উষা ও সন্ধ্যার একটি রূপ দেখেছি, নববধূর মতো তা সকরুণ। আধুনিক দুঃশাসন জনসভায় বিশ্বদ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে লেগেছে; ও দৃশ্যটা আমাদের অভ্যস্ত নয়। সেই অভ্যাস পীড়ার জন্যেই কি সংকোচ লাগে। এই সংকোচের মধ্যে কোনও সত্য কি নেই। সৃষ্টিতে যে-আবরণ প্রকাশ করে, আচ্ছন্ন করে না, তাকে ত্যাগ করলে সৌন্দর্যকে কি নিঃস্ব হতে হয় না।"
কিন্তু নদী যেমন চলার পথে গতি পাল্টায়, সাহিত্যেও তেমনি এক একটা বাঁক আসে। আসলে সময়ই তাকে পাল্টায়, বিজ্ঞান তাকে পাল্টায়। বিজ্ঞান এসে আস্তে আস্তে মানুষের থেকে তার অবসরের সময়টাকে কেড়ে নিল। এতদিন যে প্রকৃতিকে মনে হয়েছিল মায়া, বিজ্ঞান এসে বল্ল না- এ আসলে অণু ,পরমাণু, গণিত । এ বাস্তব । সে মানুষের অভিরুচি মেনে চলে না। তার কাছে ফুল যেমন বাস্তব, তার পাশে নর্দমার জলও বাস্তব । তার আকাঙ্ক্ষা সত্য অনুসন্ধানের--আমিকে বাদ দিয়ে বস্তুটা কি সেই কৌতূহলেই তার আনন্দ ।তাই সময়ের ব্যয় সঙ্কোচ যখন শুরু হল তখন সবার আগে বাদ দেওয়া হল প্রসাধনকে । একেই আধুনিকতার লেবেল এঁটে সাবেক কাব্য থেকে আলাদা করে রাখা হল ।"সাবেক-কালের যে-মাধুরী তার একটা নেশা আছে, কিন্তু এর আছে স্পর্ধা। এর মধ্যে ঝাপসা কিছুই নেই। "
তাই এবার ব্যক্তিকে সরিয়ে স্থান নিল বস্তু ।এজন্যই কাব্যে বাস্তবতাকেই আগে রাখা হল,অলঙ্কার হয়ে পড়ল বাহুল্য ।"কেননা, অলংকারটা ব্যক্তির নিজেরই রুচিকে প্রকাশ করে, খাঁটি বাস্তবতার জোর হচ্ছে বিষয়ের নিজের প্রকাশের জন্যে। "
আসলে আর্টের ধরনাটাই আস্তে আস্তে বদলে যেতে লাগল, এখন তার লক্ষ মনোহারিতা নয় মনোজয়িতা ।সে মোহ কে ছেড়ে সমগ্রতার দিকে গেল , সে সাহিত্যের মাধ্যমে সৃষ্টির মাধ্যমে নগ্ন সত্য পৃথিবীটাকে প্রকাশ করে দিল । সে শুধু সময়ের সঙ্গে পা ফেলে চলবে, সেটা সুন্দর হল না অসুন্দর হল সেদিকে সে মুখ ফেরাবে না ।পটললালের খাটা পায়খানাও কাব্য, তার পাশের বাড়ির দোতলার বারান্দায় যে নীল শাড়ি শুকায় সেটিও কাব্য । পটলাল প্রতিদিন খবরের কাগজথেকে মৃতের সংখ্যাটা ডাইরিতে টুকে রাখে ।টুকতে টুকতে ভাবে তার মাথার ভিতর দিন রাত এক ব্যাঙ ডাকে ।মলয় চৌধুরীর জখম কবিতার দুটি লাইন দিয়ে এখন লেখা শেষ করছি
"বুকের বাঁদিকের আর্মেচার পুড়ে গেছে বহুকাল
এখন চোখ জ্বালা করছে মলয়ের কঙ্কাল জ্বালানোর ধোঁয়ায়"
৫আমাদের পটললালের মঝে মাঝে মনে হয় কবিতা কেন পড়ি, বা কবিতা কেন পড়ব ?তবু পটললাল কবিতা পড়ে,এই জন্যে যে পাছে ভালো কিছু হাতছাড়া হয়ে যায়...তা না হলে কবিতা না পড়েই দিব্বি কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে, এই রকম মানুযের সংখ্যাই বরং বেশি— যারা গল্প উপন্যাস পড়েন, তথ্যাশ্রয়ী গদ্য রচনা পড়েন অথচ কবিতা না পড়েও বছরের পর বছর দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারেন। তবু কি তারা কখনো কবিতা পড়েন নি? পড়েছেন পটললালের মতোই—পাঠ্য বইয়ের কবিতা গুলি, বা রবিন্দ্র-নজরুলের আবৃত্তি যোগ্য কবিতাগুলি যেমন ‘আফ্রিকা’, ‘বলাকা’, বিদ্রোহী’র মতো কবিতা। বা আবৃত্তি শুনতেও ভালোবাসেন ‘আমিই সেই মেয়ে’ মতো কবিতার আবৃত্তি । কিন্তু এই আকস্মিকতার বাইরে শুধু কবিতার আগ্রহে কবিতা পাঠ করেছে এমন ঘটনা পটললালের জীবনে ঘটেছে বলে সে মনে করতে পারে না...তেমনি একান্ত নিরিবিলিতে শুধু কবিতা পাঠের জন্য কোন কবির কোন এক বই খুলে বসেছি এমন অভিজ্ঞতাই বা আমাদের কতজনের আছে ?আগে একটা সময় ছিল আমাদের পিতামহ-প্রপিতামহ দের আমলে, যখন আবসর সময়ে তারা রামায়ন, মহাভারত খুলে বসতেন বা কোন মঙ্গলকাব্যের মতো একম্তই পদ্যে লেখা কোন গ্রন্থ । সে সময় রসসাহিত্য বলতে যেটুকু ছিল সেটুকুই থাকত পদ্যের আশ্রয়স্থলে ।তারপর যুগ বদলেছে, বিজ্ঞান এসে আস্তে আস্তে প্রকৃতির রহস্যগুলি খুলে দিয়েছে...চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলেছে-দ্যাখো, তোমরা যে সব গুলিকে মায়া বলে জানতে সে গুলি আসলে পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা , গনিত ইত্যাদিবই কিছু নয় । মায়া বা ইলিউসালের জায়গা নিল বিজ্ঞান ও তার সত্যঅনুসন্ধানের কৌতুহল । জন্মনিল বাস্তক সত্যকে প্রকাশ করার ভাযা, ছলা-কলার অশ্রয় থেকে বেরিয়ে এসে আত্মপ্রকাশ করল গদ্য বা নতুন অঙ্গিকের কবিতা, যাকে আমরা আধুনিকতার লেবেল পরিয়ে দিলুম ।ক্রমর্বমান বিণিজ্যিক বিভীষিকা, নগরসভ্যতার নতুন ক্রিতদাস শ্রমিক, ধর্মে আস্থাহীনতা, চিন্তাজগতে নৈরাজ্য ও জগত জোড়া অনিশ্চয়তা আমদানি করল এক নতুন বাস্তবজীবনমুখিতা, বলিযষ্ঠতা ও সত্যভাষিতা যার আলোকে সাধারনের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। পদাবলী আশ্রিত নারীহৃদয়ের কবোষ্ঞ আবেগ, প্রেম প্রীতি নির্ভর গার্হস্থ্যজীবন-বন্দনাতে অভ্যস্ত হয়ে কবিকৃতি সম্পর্কে যে নিশ্চিত ধারনা তৈরী হয়ে গিয়েছিল তার মূলে কুঠারাঘাত পড়ল ।রোমান্টিক প্রকৃতি ধ্যানে এল সংসয়, সৃষ্টির মূলে হল দেহের প্রতিষ্ঠা । আকুন্ঠ আত্মবিশ্লেষনকে পাঠকের মনে হল ভন্ডামি, কপট আত্নগ্লানি । কবির সৃজনবাসলা আর পাঠকের রসপিপাসার ভরকেন্দ্রটা ক্রমশ নড়বড়ে হয়ে পড়ল ।
পাঠকের মনে হল-“ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/ পূর্নিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”।
পটলালের বউ যখন রাতকরে অফিসথেকে ফেরে তখন পটললালের মনে হয়-“জ্যোৎ স্না যেন ঘেয়ো কুকুরের মতো পরোকিয়া করে যায়”।
 পটললাল আমাকে একবার কালিদাশ ও শকুন নিয়ে তার একটা স্বপ্নের কথা বলেছিল—‘একদিন কালিদাশ দেখল তার গজদন্ত মিনারের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন এসে বসেছে, সে বুঝতে পারছেনা এত শকুন কোথাথেকে এল!সেই শকুনেরা একটা করে তার কা্ব্যের লাইন খাচ্ছে আর তখনি তারা একএকটি সুকুমার পাখি হয়ে যাচ্ছে । সে সব মাতাল পাখি । তারা সব মামুষদের কামড়াচ্ছে আর মানুষও পাখি হয়ে গিয়ে বইমেলা যাচ্ছে”।
 হিচকক কিন্তু তার সিনেমায় আর এটা দেখালেনণা ।
এই পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে কবি তা হলে কি করলেন?
সুধীন্দ্রনাথ দ্ত্ত বল্লেন-“জনসাধারনের রুচির প্রতিআমার অশ্রশ্রদ্ধা এত গভীর যে তাদের নিন্দাপ্রশংসায় আমি উদাসীন.....যারা কবিতাকে ছুটির সাথী বলে ভাবে,কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃদকম্মন অনুভব করতে চায় তাদের কবিতা না পড়াই উচিত”।
কবিরা বল্লেন কবিতা সাহিত্যের গতানুগতির রস দ্বারা পুষ্ট নয়। কবিতা বুঝতে হলে পাঠককে এগিয়ে আসতে হবে, আধুনিক কালের বিপর্যয় ও সঙ্কট টিকে বুঝতে হবে,মনসমীক্ষার বকযন্ত্রে আধুনিক কাব্যরীতির পাঠনিতে হবে। এ ঠিক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতরস আস্বাদনের মতো ।কবিতার সঙ্গাটাই যে পালটে গেছে সেটা বুঝতে হবে ।মনের সে অনুশীলন করতে হবে । পটললাল তো তা বোঝে না, সে বুঝল ইনিয়ে বিনিয়ে ছন্দ মিলিয়ে দিলেই বুঝি কবিতা হয়—ক্লাস সেভেনে উঠে পাশের বাড়ির ফুলটুসিকে চিঠিতে লিখল—“তুমি মম হৃদয়ে বীরাঙ্গনা/তুমি মম জীবনে বারাঙ্গনা”।
 তারপর যা হয় আরকি সে চিঠি পড়ল ফুলটুসির মা’র হাতে...অতয়েব প্রহারে কবিতার পলায়ন ।পটললাল তো আর বুঝলনা যে কবিতা আজ এখন আর স্বাভাবিকের সহজ অধিকার নয়, নগর সভ্যতা যেমন বৈদগ্ধ্যের বহির্লক্ষন, তেমনি কবিতাও—কবিতাও সেই একই বৈদ্গ্ধ্যের সচেতন শিল্পকৃতি ।আগে যে কারনে মানুয কবিতা লিখত সে কারনটাও গেল গুলিয়ে। কবি এলিয়ট বল্লেন—“The Poet must become more and more comprehensive, more allusive, more indirect, in order to force, to desolate if necessary, language into his meaning”
কবি নিজেকে নিজের কবিতা থেকে বার করে আনবার চাবিকাঠি বারকরে আনলেন, পাঠকে বল্লেন তোমরাও তোমাদের “নিঃসৃত সত্তাকেই পাবে আমার কবিতায়” ।
এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সাধারন পাঠক confusion এর মধ্যে পড়ে গেল, সে সরে গেলেন কবিতার কাছথেকে, কবিতাকে এক দুর্বোদ্ধতার লেবেল এঁটে দিয়ে ।

পটললাল তার ডাইরিতে একবার লিখলে “ভালোবেসে বইটিকে”...এ কোন বইয়ের নাম নয়, এ একটা সূচি, যে ভালো ভালো বইগুলি, অর্থাৎ যে বইগুলি তার ভালো লেগেছে সে গুলির একটি তালিকা সে তৈরি করে রেখেছে। সেখানে উপন্যাস আছে, গল্প আছে, প্রবন্ধবই আছে কিন্তু কোন সম্পূর্ন কাব্যের তালিকা সেখানে নেই। কিন্তু পটললাল তো মাঝে মধ্যে কবিতা পড়ে, কোন আসরে কবিতা আবৃত্তি হলে সে মন দিয়ে তা শোনে তবু সম্পূর্ন একটা কবিতার বই সে মনে করতে পারে না। তাহলে এই যে এতো কবিতা লেখা হচ্ছে, এতো আয়োজন কবিতা প্রকাশের, বইমেলাকে ঘিরে, পূজাসংখ্যা ঘিরে, সে ক্ষেত্রে এত কবিতা পড়েন কারা? বস্তুত কবিতার সাধারন পাঠক কারা?একটি অখন্ড সার্বভৌম কাব্য পাঠকের ধারনা করা নিছকই কল্পনা মাত্র। একটি বৃত্ত টেনে সে গোষ্ঠিকে আলাদা করাও যায় না ।আমাদের প্রাচীন আলঙ্কার সর্বস্ব কবিরা বলেগেছেন কাব্যরস হচ্ছে “সহৃদয়হৃদয়সংবাদী” ।
 একান্ত রসিক চিত্ত ব্যতিত কাব্যরস অনুধাবন করা অসম্ভব । অর্থাত কবি যে ভাবকে বা রসকে মূর্ত করতে চান তা যদি পাঠকের মনের অনুকূল না হয়, তবে সেই কাব্য সেই পাঠকের কাছে ব্যর্থ। “কবির কাজ পাঠকের চিত্তে রসের উদবোধন।...কাব্য কোন পাঠক বিশেষের মনে রসের উদ্রেক করবে কিনা তা কেবল কাব্যের উপর নির্ভর করে না, পাঠকের মনের উপরেও নির্ভর করে” --(অতুলচন্দ্র গুপ্ত)।
সুতরাং পাঠকে্রও একটা দায়িত্ব আছে কাব্যকে ‌আত্বীকরনের বিষয়ে। অর্থাৎ কবিতার ইমেজটিকে পাঠকের মনে ধরা দিতে হবে । তা যদি না হয় তবে সে প্রকৃত কাব্য পাঠক নয়। যেমন কবিতার প্রতি পটললালের প্রীতি আছে, প্রেম আছে কিন্তু সে কবিতার ইমেজটিকে মনের প্রজেকটারে ফুটিয়ে তুলতে পারে না।
এ ক্ষমতা অনেকেরই নেই, কবিতা আস্বাদনের ক্ষমতাও সকলে্র নেই কথাটা রূঢ় হলে্‌ও সত্য । এতো কোনো যান্ত্রিক পক্রিয়া নয় যে কবিতার ভাব ও রসের অভিজ্ঞতাটিকে ইলেকট্রিক করেন্টের মতো পাঠকের স্নায়ু তন্ত্রীতে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে! এর জন্যে পাঠকের কাব্য পাঠের উপযোগী অনুশীলনের প্রয়োজন। কারন আগের সে দিন নেই যে ভাবের ছলাকলা আর অলঙ্কারের, ছন্দের চাতুর্যে পাঠকের হদয় উদ্বেলিত হবে । যেহেতু যুগের সঙ্গে কবিতার অঙ্গিক বদলেছে, সেইসঙ্গে কেরিয়ারসর্বস্ব সমাজ ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে । ফলে পাঠকের বৃত্তটি গেছে আরো ছোট হয়ে ।বলতে গেলে কবিতার প্রয়োজন কি কমেছে, আজকের সমাজ বিবর্তনে ? ত হলে এই যে এত পত্রিকা এত কবিতা ? এসব কারা ? যারা লিখছে, কবিতা , শুধু কি তারাই এ ছোট বৃত্তের মধ্যে আছেন? মনে হয় তা সত্য নয় । কারন তা হলে প্রকৃত কবিতার, সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলির জন্ম হত না । এই প্রসঙ্গে কবি হুইটম্যানের একটি উক্তি স্মরনীয় : To have great Poets there must be great audiences too.
সুতরাং বাংলা ভাষাতেও কবিতার পাঠক আছে । এবং কবি ও পাঠকের এ বন্ধনকে শক্ত করতে উভয়কেই এগিয়ে আসতে হবে । না হলে এ মিলন সম্পূর্ণ হবে না ।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন “ বার বার ব্যর্থ হয়েও চেষ্টা করেছি সেই কবিতা লিখতে, নিজস্ব মহিমায় অম্লান থেকেও যা অনেক জনের কাছে পৌছাতে পারবে। কবি ও তাঁর পাঠককে যেখানে মেলানো যাবে।.........................পাঠক, আপনিও আপনার পোশাকি প্রত্যাশা এবারে বর্জন করুন। তা নইলে আমাদের মিলন সম্পূর্ন হবে না”।

দুপুরের পরিত্যক্ত প্রলাপ

দুপুরের পরিত্যক্ত প্রলাপ

স্মৃতির হাতে একটা দুটো পাখা
স্মৃতি বলে—‘যাই’
স্মৃতি বলে—‘মরনঝাঁপ যায় কি চেনা
একটা দুটো ফুলকি পেলে
মনের মতো ওড়াই’ ।



সেই দুপুর চিলেকোঠায় নেই
সেই দুপুর বুকের মাঝে
বুক ছোঁয়ালে
বুক জ্বলে যায়
বুক জ্বলে যায়
এত আগুন ।



আমি তোমার নাম জানিনা
আমি নেই তোমার জ্বরের কাছে,
মাথার পাশে,
পরিত্যক্ত তবু শুয়ে আছি
আজীবন তোমার পাপোষে ।



জলে ভেসে যায় শুকনো পাতা
জলে ভেসে যায় ২২শে শ্রাবণ
জলে ভেসে যায় “আয় সুখ”
জলে ভেসে যায় “যায় সুখ”
পথ ছাড়ো।



কে জানে কার চোখের ভিতর
কতখানি চোখ—
কে জানে কার শোকের ভিতর
কতখানি শোক,
আমি চোখ মেলে শোকের পাশে
শুয়ে আছি !



ফুটপাথের ন্যাংটো ছেলেদের রাজা ডেকে বলল
কি যে বলল—
ভাবতে ভাবতে মে দিবসের মিছিলের মতো বৃষ্টি এলো
দেখলুম সামনে দাঁড়িয়ে মেহের আলি
চিৎকার করছে—তফাৎ যাও— তফাৎ যাও



দুপুরের রোদে সব পুড়ে যায়
অধর—চোখ—চুমু—
বুক খানি থেকে গেলে
শুধু সে টুকুই মনে হয়—‘ছাইদানি’!



দিদি আসে দিদি যায়
ভাই গুলি তার রোদ
বোন গুলি তার মেঘ
এই রোদে এই মেঘে ভাসতে ভাসতে
কেন জানি মনে হয়
দিন বদলায় ।


কোন দিন মেলায় গিয়ে হারিয়ে গেলে বেশ হত
মনে লেখা হয়ে যেতো শুধু মুখ গুলি—শুধু মুখ গুলি ।