Search This Blog

Sunday, December 30, 2012

টুকি



টুকি
অবিন সেন

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মনে পড়ে
কোনও ভাসমান ঘোড়সওয়ার আমার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে
চিবিয়ে নিচ্ছে দু-এক মুঠো অন্ধকারের বিচালি
কিংবা ফুচকা ওয়ালার তেঁতুলজলের বিষাদ,
টুকরো আলোর ইনডিকেটর ও তুচ্ছ কিছু মুহূর্ত !


মৃতদেহ সৎকারের পরে ঘরে ফিরে এসে আমার আর সারারাত ঘুম আসে না । আসতে পারে না? সারা গায়ে যেন তাপ লেগে থাকে, তাপ ভীষণ তাপ । পারমিতা ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক্ষন । ঘুমের ভিতরেই সে বলল—“টুকি!” আমি চমকে উঠি। আমি আবার শুনতে পাচ্ছি পারমিতা খাটের নীচে থেকে ডাকছে—“টুকি!”
আমি অনবরত শুনতে পাচ্ছি টেলি ফোনের বিপ বিপ রিংটোনের মতো পারমিতা ডেকে চলেছে “টুকি” “টুকি”
বাইরে এখন অনেক রাত, তথাপি হেমন্তের শিশিরে ভিজে আসছে ছাতিমের সুবাস। অন্ধকারের ভিতর জানালা দিয়ে আবছা ছাতিম গাছটা দেখতে পাচ্ছি।
পারমিতা পাশ ফিরে শুল এবার। তার একটা হাত এসে পড়ল আমার গায়। আমার ডান হাতের কনুইয়ের উপর তার স্তন। যেন ছাতিমের মাদকতায় ভণ্ডুল হয়ে সেই প্রগাঢ় স্তন আমায় উষ্ণতা দিচ্ছে অথবা দেওয়ার এক অভিলাস অন্ধকারের ভিতর ঘোড়সওয়ার হয়ে আমার উপর বসেছে—দু পা মেলে, চার পা মেলে অদ্ভুত স্বৈরিণী। কিন্তু “টুকি”!
বিয়ের পর প্রথমবার দীঘা গিয়ে এমনটাই হয়ে ছিল। সারা ঘরে লুকোচুরির মতো শুধু পারমিতা হরিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গমের সময় তার ভিতরে আমার পৌরুষের পাশবিক ভঙ্গি অথচ আমার সমস্ত সত্তা জুড়ে কেবলই মনে হয় শূন্যের ভিতর রতিক্রিয়ার ব্যকুল শৈত্য। যেন পারমিতার আড়াল থেকে পারমিতার ছায়া বেরিয়ে এসে আমার সঙ্গে রতিক্রিয়া করে ।
আমার ভীষণ ইচ্ছা করছিল পারমিতার “টুকি” ডাকে একবার সাড়া দিই বা দেওয়ার ভঙ্গি আমার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে চেপে ধরে আর কাঁপতে থাকে তির্ তির্ করে ঝাউ পাতার মতো । যেন নদীর দিক থেকে বয়ে আসছে বাতাস । তার হিম ।
আমি আরো গাঢ় হয়ে পারমিতার উষ্ণতার দিকে সরে যাই । গায়ে চাদর টেনে নিই । কিন্তু তখনো শুনতে পেলাম পারমিতা ডাকল—“টুকি”!
এ কি আমার স্বপ্ন। নাকি স্বপ্ন ভেঙে যাবার পরের নিদারুণ বিমূর্ততা ? সেটুকু ভালো করে বোঝবার জন্যে আমি পারমিতার দিকে আবার আড় চোখে তাকই। আর তাকাতেই কেমন যেনে ভেড়া হয়ে যাই । দেখতে পাই পারমিতা অন্ধকারের দেওয়ালের ভিতর এক অচেনা দরজা খুলে ক্রমশ তার মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে । ওদিকে কি অভয়ারণ্য ?
আমি চিৎকার করে বলতে গেলুম পাতমিতা যেওনা । যেওনা ওদিকে।
ওদিকের কোনো টেলিফোন নাম্বার আমার জানা নেই। জানা নেই ওখানে কোনো মোবাইল সিগনাল কাজ করে কিনা !
পারমিতা খিল খিল করে হাসল ।
তার হাসির শব্দ মিলিয়ে গেলে শুনতে পেলাম—“টুকি” ।
আমি তাকিয়ে দেখছি, পারমিতা যে দেওয়ালের ভিতর প্রবেশ করল সেটা আসলে একটা বাড়ি । একটাই বাড়ি। গম্বুজের মতো । কোনো জানালা নেই। আস পাশে কোনো বাড়ি নেই । শুধু সেই একমাত্র বাড়ি । শাদা চুনকাম করা । চারপাশে গাছপালা, যেন সদ্য বৃষ্টি ভেজার পরে ঝিল্ মিল্ করছে । আমি যত সেই বাড়ির দিকে এগিয়ে যাই তত গাছপালা গুলো পরস্পর সরে গিয়ে আরো ঘন হয়ে দাঁড়ায় । যেন আমার পথ আটকে রাখতে চায় । আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাদের সেই গমন দেখি । আর দেখতে পাই গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বিলাস। হাসছে । আমি তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম ।
অথচ বিলাস মারা গেল গত ভোরবেলা । এমন একা একা যে মনে হয়েছিল ভোরবেলার সমস্ত হিম যেন আত্মীয়ের মতো তার ঘরে পা-ছড়িয়ে বসে থেকেছে । হয়ত একা একা মরাটা তার একটা বিলাসিতা ছিল । তাই কি ? হয়তবা । আমি জ্ঞানে বা অজ্ঞানে বলাসের কোনো আত্মীয়কে দেখিনি । আদৌ কেই কোথাও ছিল কি না কে জানে বা জানার ভঙ্গীকরে কোনোদিন তার কাঁধে হাত রাখিনি । বিলাস আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে এসে জুটেছিল বা আমরাই তাকে জুটিয়ে নিয়ে ছিলাম । আমি ও পারমীতা । গতরাতে যখন শিশিরের আঘাতে শিউলি ঝরছিল তখন সেই ঝরা শিউলির ভিতর—হিমের ভিতর বিলাস একা একা মরে গেল। খোলা জানালা দিয়ে কোনো ছাতিমের সুবাস কি তার মাথার কাছে এসে বসেছিল?
এই যে এখন যেমন আমার মাথার কাছে এক অলীক পারমিতা ক্রমাগত ডাকছে—“টুকি, টুকি, টুকি”।
শুনতে পাচ্ছি এবং বলা ভালো দেখতেও পাচ্ছি পারমিতা এখন বসন্তের ফাগুন বউটির মতো হয়ে আছে । লজ্জাশীল-ব্রীড়ানত । সদ্য কনসিভ করেছে সে । ডালা ডালে তার বসন্তী ফুলের মতো সোহাগ।
আচ্ছা, পারমিতা যে কনসিভ করেছে তা কি বিলাস জানত? কথাটা আমার হঠাৎ মনে হল । কেন?
দীর্ঘদিন আমাদের  ফসলের ভূমি ছিল অকর্ষিত। ফসলের । সবুজ সিমের আকাঙ্ক্ষা সন্তান সন্ততির হাত ধরে মাঠের আলপথ ধরে হেঁটে যাবে আর হেমন্তের বিকেলে কিংবা শিশিরের ঘেরা টোপে নাড়ার আগুনে একটু সোহাগ ভরে নেবে চাদরের কোঁচড়ে। পারমিতার সেই সব আকাঙ্খা ছিল। আমারও কি ছিল না ?
“সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমা খাবো”।
কিছুক্ষণ আমার তন্দ্রার মতো এসে গিয়েছিল। চটকা ভাঙতে দেখলাম রাস্তার পাশে সমস্ত দোকানের সাটার নামানো আর আমি সেই শাদা রাঙের বাড়িটা খুঁজে পাচ্ছিনা । ল্যাম্পপোস্টের কাছে বিলাসের সঙ্গে দেখা।
শালা, তখনো দাঁত ক্যালাচ্ছে ।
আমাকে দেখে বলল—কি খুঁজছিস ?
-একটা শাদা বাড়ি ।
-অভয়ারণ্য?
-না, একটা শাদা বাড়ি। তার সবকটা জানালায় জানালায় খড়খড়ি নামানো। দরজাগুলো বন্ধ।
-বেশ্যাখানা ?
-না !
- ?
-আমি কখনো বেশ্যাখানা দেখিনি।
-যা শালা !
-কোনও দেবালয়ও দেখিনি ।
-ধুর, বোকাচো......
আমি হাসলাম । বিলাসের মুখখানা ওলটানো ব্ল্যাক ডগের বোতলের মতো লাগছিল । ইচ্ছা হল শালার গাঁড়ে কোষে এক লাথি দি।
কিন্তু তখনি শুনতে পেলাম—“টুকি” । হাত বাড়াতে রক্ত মাংসের পারমিতা হাতে ঠেকল । আমার হাতের থেকে আরো দীর্ঘ  এক হাত বেরিয়ে এসে পারমিতার মাংসল নিতম্ব জড়িয়ে ধরতে চাইল। কি তীব্র উষ্ণ সে মাংস । আমি চাদর সরিয়ে উঠে এসে জানালার সমনে দাঁড়াই। বাইরে শিশির ঝরছে । ক্রমশ সেই শব্দ আমি যেন শুনতে পাই, শুনতে পাই পাতার থেকে ঝরে পড়ছে স্নানের পরে পারমিতার চুলের থেকে জল, শিশির। আমার খুব হস্ত-রতির ইচ্ছা জাগে । খুব । যেন কল খুলে দিয়ে জলপাড়ার শব্দের ক্লান্তি । আমার যৌনাঙ্গের উপর দিয়ে হেঁটে চলে যায় পারমিতার ছায়ার শরীর । হেঁটে গিয়ে সে খুলে দিচ্ছে চারপাশের সমস্ত বন্ধ দরজাগুলি।
বিলাস সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করে। বিলাস ?
আমার সন্ধেহ হয় ।

নিস্তব্ধতার ভিতর কয়েক যোজন পা মেলে দিয়েছে গাছগুলি
তারা কি এগিয়ে গিয়ে শিশির ছোঁবে ?


সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি নিপুণ হাতে এক দুর্গের দ্বার খুলে দিই । দেখি সকালের রোদে ভেসে যাওয়া বারান্দায় একটি শালিক এসে বসেছে। গ্রিলে । আমার মুখো মুখি সে একটি হিজল গাছের ঘন পাতার মতো বসে থাকল স্থির । আমার বড় অস্বস্তি হয় । এক শালিকে এই অস্বস্তি আমার চিরকালের । মনে হল আমার চোখের ভিতর দিয়ে সে তাকিয়ে আমার সমস্ত অশুভ নক্ষত্রগুলিকে দেখে নিচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।
আমার অস্বস্তি আরো বাড়ত হয়ত—পারমিতা এলো।
চায়ের কাপ রাখল নিচু টেবিলের উপর ।
আমি কি পারমিতাকে শাদা বাড়ির কথা জানতে চাইব ?
কিন্তু আমি দেখেতে পাচ্ছি পারমিতার চারিদিকে হিজল বন ছেয়ে আছে। ছায়া দিয়ে আছে। আমার খুব ইচ্ছা করছিল আমি সেই ছায়ার নীচে দাঁড়াই। পারমিতাকে ছুঁয়ে দাড়াই।
পারমিতার ছায়া আড়াল করে বিলাস দাঁড়িয়ে আছে।
পারমিতার ভিতরে বিলাসের সন্ততি ?
আমার অসহ্যে মাথার ভিতর কুয়াশা ভণ্ডুল হয়ে থাকে।
আমি শীতের শুকনো পাতার মতো..................................................
............................................................................................

ফ্রিজ থেকে আর একটা সিগনেচারের বোতল নিয়ে আসে পারমিতা।
বিলাস তখন হাসছিল।
হাতের তাস টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাসল। হা হা করে গলা ফাটিয়ে সে হাসল।
ধুর বাঁড়া....তার পর জিব কাটল। সরি পার...মিতা...
তার কথা জড়িয়ে আসছিল।
আমার সমনে সে কখনো পারমিতাকে নাম ধরে ডাকে না। সেদিন ডাকল। আমি ছায়ার মতো অন্ধকারের ভিতর ঢুকে যাচ্ছিলাম।
আমি উঠে যাচ্ছিলাম। পারমিতা আমার ঘড় ধরে বসিয়ে দিল । না না...সে কি পারমিতা? আর হাত কি অ্যাত হিম? এত কঠিন?
কিংবা উত্তরের কঠিন হাড় হিম হাওয়া আমার ঘাড় ধরে বসিয়ে রাখে । আমি অবহেলায় দেখতে পাচ্ছিলাম আমার অসাড় হাত একটার পর একটা সিগনেচারের পেগ তুলে নেয়। সেই পেগ ভর্তি অজস্র হাসির খেউর। ফ্যাক্টরির চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়ায় বিকেলে পথঘাট ঢেকে গিয়েছে। রিক্সায় আমি আর পারমিতা ফিরছিলাম। মাথার ভিতর ডাঃ বিষ্ণু র কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল ।
-না না মি বোস..আই অ্যাম সরি, আপনার মিসের সব টেস্ট রিপোর্ট ঠিকই আছে। কিন্তু আপনার.........
আই মিন আপনি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই মি: বোস....
আমার চোখের সামনে তখন বিকেলের পথঘাট...বৃষ্টির পরে ভেজা ভেজা বাতার । কোথাও কোনো ত্বরা নেই...কিছু বলার নেই। পারমিতার হিম হাত আমার হাতের ভিতর। তারও কিছু বলার নাই। আমাদের বর্ষাকাল শেষ হয়ে এলো। আমাদের ফসলের আকাঙ্ক্ষা গ্রীষ্মে নদী নালা শুকিয়ে এলে পর যেমন নিশ্চুপ তেম্নি শান্ত। পারমিতাও শান্ত। শুধু রতিক্রিয়ার সময় সে আমার ভিতর থেকে হারিয়ে যায়...আমি তাকে খুঁজে পাই না। খুঁজে পাই না মোটে । দেবদারু অরণ্যের ভিতর থেকে সে সাড়া দেয়....টুকি—টুকি—

আমি কখনো কোনো দেবালয় দেখিনি...
দেখিনি কোনো বেশ্যালয়.....



অফিস থেকে ফিরে দেখেছিলাম পারমিতা ঘরে নেই।
থাকার কথাও নয় ?
তখন ফসলের সময়। কর্ষণের সময়।
আমি চারিদিকে ট্রাক্টরের আওয়াজ শুনতে পারছিলাম ।

জানালার পিছনে এখন তীব্র ট্রাক্টরের শব্দ
অনবরত....

এখন কর্ষণের সময় । ফসলের সঙ্গে মানুষের উচ্চাশার নিবিড়তা
সমাচারের মতো সমস্ত শিরা উপশিরা বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে । এখানে কথাবলা মানা ।

চলো বাইরে গিয়ে দাঁড়াই । কথা বলি।
ঘরের বাইরে কি উচ্চকিত শব্দ নেই ?
বাইরে ?
ঘরের থেকে বাইরে ?
নিজের ছায়ার থেকে, ছায়ার বাইরে—
পেঁয়াজের মতো এমনি পরস্পর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে
জীবনের থেকে জীবনের পরম্পরায়....

দেখি
এক নদীতীরে দাঁড়িয়ে আছি
বাতাস নেই....ঢালু পাড় নেই....

কেবল স্রোতে ভেসে চলে যাচ্ছে অকারণ ছায়াগুলি”।


এই ভাবে ফসলের সময় পারমিতা সারা দুপুর বিলাসের কাছে থেকেছে । একদিন। দুইদিন....
তারপর...
পারমিতা ফিরে এলে তার চোখে মুখে দেখেছি নদীর সরসতা । বর্ষার শেষে যেমন খাল বিলের জল আহ্লাদে স্ফুরিত তেমনি উজ্জ্বল মেয়েটির মতো হয়ে গিয়েছে পারমিতা।
-পারমিতা...আমাদের সন্তান যদি বিলাসের চোখ-মুখ-নাক পায়?

পারমিতার ওষ্ঠ আমার মুখ বন্ধকরে দেয়। তার উষ্ণ শ্বাস বায়ু ভেঙে পড়ে আমার মুখে। সে হাঁপায় । তার পর ফোঁপায় । সমস্ত ঘর আমাদের হিজলের ছায়ার মতো ভারি হয়ে আসে। আমি সেই শাদা বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি । কিন্তু বিস্ময়ে দেখি পারমিতা সেই বাড়ির ভিতর হারিয়ে যাচ্ছে না । না না সে কোনো ভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে না । শুধু একটা জানালায় বিলাসের ম্লান মুখ । সেই বাড়ির দরজায় বাইরে থেকে তালা দিয়ে ফিরে আসছে পারমিতা। আর ফিরে এসে আমার হাত ধরেছে।


-লক্ষ্মীটি বিলাস এই ওষুধ টা খেয়ে নাও প্লিজ।
বিলাস ম্লান হাসে। নেশায়। শালা কি সব বুঝতে পারছে? বুঝতে পারছে এ ছাড়া তার কোনো গতি নেই, উপায় নেই! না হলে অমন ধূর্ত বেড়ালের মতো তাকিয়ে আছে কেন? আমি একটা একটা পেগ বানাই। পারমিতা একটা একটা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেয়।
তারপর অনেক রাতে আমরা অন্যমনস্কের মতো আমাদের ঘরে ফিরে আসি।
পরিপাটি হয়ে একা ঘরে ঘুমিয়ে থাকে বিলাস ।
বস্তুত পৃথিবীতে বিলাসের মতো একা কেউ নেই । জানালা দিয়ে আশ্চর্য এক গন্ধ সেই মাত্র আমি পাচ্ছিলাম । আমি ফিস ফিস করে বললাম—
বিলাস ছেলেবেলার কোনো গন্ধ পাচ্ছ ? পাচ্ছ না ? তাহলে গাড়ি কি রিক্সা বা কিছুর শব্দ ? কিংবা শব বহনের মতো গাঢ় ভার তোমার কাঁধে ? তাও না ।
-প্লিজ বিলাস...একবার বলো—“আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”।
প্লীজ বিলাস---

১০

চায়ের কাপ তুলে নিতে এসে পারমিতা হই হই করে বলল—
এই এই বাজারে যাও.....ঘরে রান্নার মতো কিছু নেই......শেষের দিকে অভিনয়ের মতো তার কি গলা ধরে এলো...??
আমি চেয়ার থেকে উঠতে গেলে সেই শাদা বাড়ির জানালা থেকে বিলাস ডাকল—
টুকি—টুকি—

                                                ----০----





Tuesday, May 8, 2012



চিলেকোঠার কবি

          ঝমঝমিয়ে দারুণ এক বৃষ্টি এলো দুপুর বেলা—আমার চিলেকোঠার ঘরে। বৃষ্টি তার রূপের দেমাক ভারি, তার চিকন কালো ছায়া আমার ঘরের আয়নায় লগ্ন হয়ে রইল যেন কালো পশমের মতো মোলায়েম এক ইয়ার্কি করতে থাকল, যে আয়নার সঙ্গে আমার চিরকালের আড়ি ! আমার প্রথম ব্রণ ওঠা আমি তার চোখেই প্রথম দেখি—সেই থেকে আয়নার  সঙ্গে আমার মুখ দেখা দেখি নেই। সেই আয়নায় এখন শুধু সারাদিনের আলোছায়ারা খেলা করে, এমনি সব সহজ ঠাট্টা আমার রোজনামচায় নির্লিপ্ত হয়ে আছে।
          এই আয়নায় মুখ দেখে তরু! তরু আমাদের একতলার ঘরের ভাড়াটে।
          আয়নায় আবার আমি আকাশটাকে দেখি।
          “আকাশ-মুখো মেঘের সারি,
          দিচ্ছে পাড়ি
          আয় দুপুর
          নিঝুম নিয়ে নৌকা গড়ি....”
লাইনগুলো এ বাছর প্রথম যেদিন বৃষ্টি হল সেদিন লিখেছিলুম। তারপর কতকগুলো সমান্তরাল রেখা টেনে টেনে সেগুলো কেটেছি—আবার লিখেছি—আবার কেটেছি, মাথাটা কেমন ভণ্ডুল হয়ে গেছিল তারপর—মাথার ভিতর যেন শুধু সমান্তরাল রেখা। তখন আমার চারপাশের পৃথিবী—বস্তু—মানুষ সবাইকে সমান্তরাল রেখার মতো মনে হয়, কেউ যেন কারো সঙ্গে টাচ করে নেই, টাচকরে থাকার কোনো অভিপ্রায় নেই—সার্থকতা নেই, সঙ্কল্প নেই পৃথিবীতে, যেমন আমার চিলেকোঠার ঘরে শালিক খড়কুটো ছড়াচ্ছে, মাঠের ভিতর থেকে ফসলের ভিতর থেকে খাবার খুঁটে এনে বাসায় রাখছে, বৃষ্টির পরে রোদ বিলি কেটে যাচ্ছে জানালার কাছে.....তেমনিই সবকিছু। তেমনি যেন সব।
          এমন আমার হয় মাঝে মাঝে—এমন ঘোর...এমন প্রাণের ভিতর এক নির্লিপ্ত প্রলাপ—এক নির্লিপ্ত নিঃসাড় বোধ কাজ করে—কেউ জানে না কেন এমন প্রাণের ভিতর হেমন্তের মাঠের মতো কুয়াশা—শূন্যতার ঘোর খেলা করে। মেঝে মাঝে। আজো কি তেমনই হবার ছিল।তেমনি?
          দুটো চড়ুই কিচির মিচির করে আমায় বাঁচিয়ে দিল। দেখলুম দুটো পাখি জানালার কাছে এসে আমার অনেক বয়স বাড়িয়ে.. দেখলুম আঠারো বিশ বছরের ছেলে কেমন নিমফুলের গন্ধের মতো প্রবীণ হয়ে গিয়েছে। অথচ নিমফুলের গন্ধে কতই না ব্যথা, ব্যথা দিয়েছে প্রাণে সেই সব অলীক ফুল, সার্থকতা—ভণ্ডুল হবার জন্যে ব্যর্থতায় সমস্ত সরলরেখা গুলো যেন একে অপরের ঘাড়ে পড়ে যাচ্ছে হুড়মুড় করে। আর তার পর আমার সমনের পৃথিবীকে নানা রঙের ছাপ ছাপ মোজাইকের টালির মতো হয়ে যেতে দেখি।
          তরু কখন এসেছে বৈদেহীর মতো হঠাৎ খেয়াল করলুম। মা বলে তরু বাতাসের মতো আসে যায়, এমনি মৃদু..নিঃশব্দ যা শারীরিক দৈন্যে প্রকট, হাঁটা চলা তাই শব্দহীন যেন তার। শব্দ বা হল্লার দিকে নির্লিপ্ত। অসুখে ভুগে ভুগে শরীরের সমস্ত পুষ্টি যেন স্থগিত হয়ে গিয়েছে। যেমন অন্ধকার প্রাচীরের আড়ালে ঘাসেরা হলুদ নিস্তেজ হয়ে যায়, তেমনি এক অসুখের অন্ধকার এক দেওয়াল তরুকে ঢেকে দিয়েছে, অথবা সেই অন্ধকার দেওয়ালের নীচে তরু যেন চাপা পড়ে গিয়েছে।
          সে চুলে শ্যাম্পু করেছে। তার সেই হালকা সুবাস নাকে লাগল। ছেলেবেলায় যেমন বাবলার সুবাস পেতাম, তেমনি সহজ...তেমনি সহজ তার মুখ, তেমনি নিষ্পাপ। তেমন যেন কোথাও দেখনি। তার দিকে তাকালে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। এমনি ভোরের মতো নরম সেই মুখ।
          তরু কোনও কথা বলেনা। চুপি চুপি এসে জালাটা খুলে দেয়। এতক্ষণ ঘরের ভিতর যে বাতাসটা বন্ধী হয়ে ছিল, সে যেন হঠাৎ মুক্তি পেল। আর সেই শূন্যতার ভিতর কিছু ঠাণ্ডা বাতাস এসে যেন আমোদ শুরু করে।
          তরুর নাইটিতে ফুল ফুল বিষণ্ণতা। তার আজো জ্বর এসেছে। তার কপালে হাত রেখে আমি সেই উত্তাপ টের পাই।
          পাখিদুটো তখনো ঝগড়া করে চলেছে।
--দ্যাখ, পখিদুটো সমানে জ্বালাচ্ছে।
--জ্বালাক না!
তরু আড়া হয়ে শুল হাতে ভর দিয়ে।
পাখিদুটোকে দেখছিল।আমরা সবাই কি একদিন বাধাহীন হতে পারব? যেমন বৃষ্টির পরে এক হলুদ রঙের আলোর প্রীতি জন্ম নেয়, সোঁদা গন্ধের মতো..তখন পৃথিবী কি কার্ত্তিকের মাঠের মতো হয়ে যায়! ফুলগুলো—গাছগুলো? স্কুলের মাঠের পাশে হাসনুহানা ফুটতে দেখেছি একদিন, দেখেছি তার ঢের আঘ্রাণ শালিকের ডানায় বিকেলের আলো হয়ে যেতে। দেখেছি স্কুলের জানালাগুলো কুয়াশায় অপরিচিত ক্যানভাস হয়ে থাকে—সেই সব ক্যানভাস ছুটির মতো সহজ—পাতায় সকালের রোদের মতো সহজ—আমরাও একদিন সহজ হয়ে যাব?
          তরুও কিছু ভাবছিল। সে কি ভাবছিল আমায় বলছিল না। আমার সামনে বসে কেউ কিছু ভাবলে আমার খুব অস্বস্তি হয়।
--এই তরু কি ভাবছিস?
তরু আমার কথায় কেয়ার করে না, স্বগতোক্তির মতো করে বলে-
‘রবিঠাকুরের একটা গান জানিস—“তবু মনে রেখো/যদি যাই চলে দূরে.....” জানিস?’
--জানি। প্রেম পর্যায়ের গান। কিন্তু এ গান কেন? এই বৃষ্টি বাদলায়?
--এমনিই! আজ যেন সবকিছু দূরে চলে যাচ্ছে, সবকিছু!
তরু হঠাৎ কেঁপে উঠল।
তরুর হাত আমার হাতের ভিতর বাসনায় বিলীন হয়ে গেলে পর আমি অস্ফুটে ডাকি
--এই তরু, তরু...
তরু আমার বুকের কাছে সরে আসে। তার মাথাটা যেন আমার বুকের কাছে মিশে যায়, শালিকের বুক ঘাসের অন্তরের ভিতর মহার্ঘ হয়ে ওঠে। তার সমস্ত শরীরটা আমার দুই হাতের ভিতর নারকেল পাতার মতো তির তির কর কাঁপতে থাকল। তার সমস্ত শরীরের ভিতর থেকে অসুখের ভাপ—মাথার চুল থেকে শ্যাম্পুর গন্ধ উঠে এসে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। আমি সেই বাবলা ফুলের গন্ধ টের পাচ্ছিলাম আবার। অসুখের পরিপূরক হয়ে উঠে সেই গন্ধ যেন পৃথিবীকে বলল—“থাক!”। আমার পৃথিবী, আমার প্রহর যেন থমকে রইল। থমকে রইল চারপাশ—চরাচর—একটা থমকে থাকা হলুদ রঙের বিকেলের দিকে যেন পিঠ করে দাঁড়িয়ে রইল পৃথিবী।
তরু কখন নীচে নেমে গেছে বুঝতেই পারিনি। আমার বুকের ভিতরটা তখন এক জাহাজঘাটের ব্যর্থ নাবিকের মতো হয়ে গেল। সেই সব ইংরেজ আমলের পুরানো আর মাস্তুল ওলা স্টিমার ছেড়ে যাচ্ছে বিকেলের গঙ্গায়। বিকেল নয়, হয়তবা তখন সন্ধ্যা—গঙ্গার পারের গাছগুলোকে কালো কালির আঁচড়ের মতো ইজেলে লগ্ন বলে মনে হচ্ছে। সেই সব গাছ এদেশের না...এদেশের হেমন্তের না...সে কোথাকার চিলির কিংবা আর্জেন্টিনার রুক্ষ মাটির গাছ, সেই রকম কোথায় এক ভাঙা ইটের বাড়ি বা সমুদ্রের ধারের বাতিঘর..তার পুরানো বাথরুম, অন্ধকার—লোনাধরা—জানালার ভাঙা কাচে ভৌতিক শব্দ, নানা রকম, সেখানে বাসে আমার প্রথম কৈশোর কবিতা লিখেছে। নখের আঁচড়ে পুরানো দেওয়ালের চুন খসে পড়েছে। সে না কার্তিকের না হেমন্তের তা কবেকার এক দ্বন্দ্ব নীচতলার ঘরের অন্ধকার...ড্যাম্প, অসুখ। কলতলার পুরানো শ্যাওলা..সবুজ এবং মনোহারী! তরু সেই অন্ধকারের ভিতর চাপা পড়ে গিয়েছে, হুড় মুড় করে সে অন্ধকার অসুখের দেওয়ালে..পুরানো ইটের দেওয়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে। সেই অন্ধকারের মুক্তি কি হাসপাতাল? সবাই হাসপাতালে যায়, আমি যাই না। আমার হাসপাতালে খুব ভয়...সেই সব শাদা চুনকাম করা দেওয়ালের হাসপাতাল,পুরানো পুরানো সব ইট, পাথর...গন্ধ..মনে হয় আদপেই কোনও সংকল্প নেই হাসপাতালের।
          রাত্রে কাকিমা ছাদে এসেছিলেন। অশরীরীর মতো পায়চারি করছিলেন অন্ধকারে। কাকিমার সমস্যা সাতকাহন। তরুকে নিয়ে—কাকুকে নিয়ে। কাকুর মতো ব্যক্তিত্বহীন মানুষ আমি দেখনি। চোখের উপরতিয়ে সংসারটা ভেসে যায় তবু তিনি বসে থাকেন উদাসীনের মতো তাঁর নিজের গান সুর তাল নিয়ে। সখের গানের মাস্টারি করে কি দিন চলে?
          কাকিমা বোধহয় কাঁদছিলেন। পৌর্ণমাসীর চাঁদ কাকিমার গালে চিকচিক করছিল জলের ধারায়। আমার চিলেকোঠার ঘরে বসে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। গুঁড়ো গুড়ো অন্ধকার আমার মনের ভিতর ঢেউ ভাঙছিল। ঢেউয়ের ভিতর তরু—গাছের মতো আবছা নীরব ছায়া ফেলে ভাসছে। আমি সেই ভাসানের ভিতর কবিতা লিখছিলুম, কাচের জানালায় কালো কালির স্কেচ পেন দিয়ে—
“পড়ে আছে পাতার শূন্যে নীরবতা
জলাভূমি শিয়রে স্মারকের মতো—
ধানক্ষেত অনাবিল হাওয়ায় শুয়ে আছে
পৌর্ণমাসী মাটি ও মনের গভীরে
গাছের জন্মের মতো
আছো?
তুমিও? ভিতরে আমার—
উঠোনে মুথা-ঘাস বেড়ে জঙ্গলা দিনে
ঘোর বর্ষায় দামি কিছু চিকুরের জল
দু-হাত ছুঁয়ে গেছে তাই!
গেছে তাই? ভেসে নাভিমূল থেকে হৃদয়ও—
মধ্যরাত্রে অব্যর্থ উৎসব—
শিউলির ঘ্রাণে দগ্ধ মনস্তাপ ।“

লেখা শেষ করেই জালাটা খুলে দিয়েছি। চাঁদের আলোয় সারারাত ভিজবে কবিতা...ভিজে ভজে যেন হয়ে যাবে কবিতার উৎসব, সমুদ্রের পারের হাওয়ার মতো মাতাল হয়ে থাকবে সরারাত। সরারাত ধরে সে ভিজবে অঘ্রানের কুয়াশায় আর শিশিরে। ভিজে ভিজে একসময় ভোররাতে আবছা হয়ে যাবে অনেক লেখা..আবছা হয়ে যাবে শিশিরে স্বপ্নের মতো ঘ্রাণ ও কবিতা।
          ঘর থেকে ছাদে নেমে এলে কাকিমা চমকায় আমার পায়ের শব্দে। দ্রুত হাতে চোখের জলকে গোপন করে নেয়।
--তুই কখন এলি?
--আমিতো ছাদেই ছিলাম!
--খেয়াল করিনি।
--কাকিমা তরু কেমন আছে?
কাকিমা চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ—তারপর স্বগতোক্তির মতো করে বললেন-
--মাথার আঘাত, কি রক্ত—কি রক্ত—তবে ছেড়ে দেবে কাল, হাসপাতাল থেকে..
আমার মনে হল জ্যোৎস্নাটা যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। অনেকটা আলো—হাসির মতো—খুসর মতো খুরে বেড়াতে থাকল সারা ছাদময়। যেন আলোর ফুলগুলি সব অন্ধকার কুড়িয়ে নিয়ে কোঁচড়ে ভরে রেখেছে। সেই আলোর ফুলের মধ্যে একটা বেমানান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন
--তরুটা বোধহয় বাঁচবে না! দিনদিন কেমন হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।
কাকিমা নীচে নেমে গেলে মনে হল জ্যোৎস্নার ভিতর কোথাও যেন অন্ধকারের ভাপ জমে আছে। সেটা যেন আমার চারপাশে ছড়িয়ে যেতে থাকল এবার।
          সেই ভাপের ভিতর মনে হচ্ছিল যেন ঘর বাড়িগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে—ঘুড়ির মতো চারপাশ জুড়ে, খড়কুটো উড়ে বেড়াচ্ছে। আমিও তাদের সঙ্গে তাল রেখে উড়ে বেড়াই। লাটাই নিয়ে এসে সারারাত আমি ঘুড়ি ওড়াই। জ্যোৎস্নার ভিতর। অঘ্রানের কুয়াশার ভিতর। ছাদের আলসের উপরদিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল এবার যদি টাল খেয়ে পড়ে যাই?
--শালা সারা আকাশটা হাসবে তখন । নক্ষত্ররা দাঁতবার করে এ ওর ঘাড়ে পড়তে থাকবে হুমড়ি খেয়েছ তার পর লাট্টুর মতো পাক খেতে খেতে মলিয়ে যাবে এক বিশাল শূন্যের ভিতর—স্বপ্নের ভিতর।
          এই সব সাত পাঁচ ঘুড়ি ও লাটাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে ভোরের দিকে আমার খুব ক্লান্তি এল। ঘুম এল চোখ উপচে। ঘুমুতে ঘুমুতে স্বপ্নে দেখলুম অ্যাকোয়ারিয়ামের ভিতর ভাসতে ভাসতে মা ও বাবা আমায় লক্ষ করছে। আর তখনি ঘুম ভেঙে মনে পড়ে গেল আজ তরু আসবে।
          তিনদিন পরে তরু এলো আমার চিলেকোঠার ঘরে। হেমন্তের মাঠে এক হলুদ রঙের বিকেল এলো...ঝাউ-বনের থেকে বাসার এলো চরুয়ের আহ্লাদ যা অপেক্ষের মতো । সেই অপেক্ষার সারি বেয়ে একরাশ পতঙ্গ উড়ে এলো—ভরে দিল ঘর-। দুপুরের দিকে দারুণ এক বৃষ্টি এলো। বৃষ্টি মতই তরু আসে...সমু্দ্রের ঘরে যে বাতি ঘরে যে নাবিক ছিল তার কাছে। বসে সে তার চিরাচরিত আলগোছ ভঙ্গিমায়...চোখ তার ফসফরাস। বুকের ভিতর হিম জমে আমার..হিম কুয়াশা, হেমন্তের প্রান্তরের মতো কিংবা কাচের মতো ভেঙে ভেঙে রক্তাক্ত করে আমার বিবেক। সেজো কাকিমার মেয়ে প্রগাঢ় প্রাগৈতিহাসিক গলায় বলেছিল একবার—“এত কাঁপছিস কেন?”আমার গলার খালি করে সমস্ত শ্বাস টেনে নিতে নিতে বলেছিল সে। তখনো আমার বিবেক কাচের মতো ভাঙে, রক্ত ছোটে ফিনকি দিয়ে সারা গা বেয়ে। এখনো মনে পড়ে সেই ভাঙা দেওয়াল..সেই নির্জন ভাঙা দেওয়াল। আমি গহন পুরুষের মতো দেখি তরুকে। আঘ্রাণ করি তার সারা শরীরের সুবাস। আমার অসাড় জিব বলে—“তরু তোকে দেখব!” তরু চমকায়। ঘরবাড়ি চমকায়। কাড়ত করে বাজ পড়ে। বৃষ্টি আসে আরও ঘন হয়ে। কাচের জানালায় সেই বৃষ্টির জল নামে। তরু তখন নারী—বৃষ্টির মতো নিবিড় চোখ তুলে চায়—তার কদম কিশোরী বুক সহজ স্রোতের মতো অতল ঢেউ ভাঙে আমার বুকের ভিতর।আমার বুকের থেকে একটা একটা কাচের টুকরো ঝরে পড়ে। ক্ষত সারে। তরু হাসে—তরু কাঁদে—

          পাগলি তরু হাসে—পাগলি তরু কাঁদে—জ্বরের ঘোরে তরু কাঁদে—তরু হাসে—তরু হাসে--এমনি নিষ্ঠুর সে হাসি—এমনি নিষ্ঠুর এক স্টিমার ঘাট...সন্ধ্যার ইজেলে সারি সারি ঝাউ গাছের ভিতর থেকে একটুখানি আলো দেখা যায়—সে ঘাট থেকে স্টিমার ছেড়ে গেলে সে আর ফেরে না..ফেরার কোনো সংকল্প থাকে না? শুধু কি কিছু কল্পনা—কবিতা—বাতিঘর আর অনাবিল হাওয়া..হেমন্তের কুয়াশায় নিবিড় হয়ে নির্লিপ্ত হয়ে থাকে....সেখানে কোনো আশা নেই...সংকল্প নেই...শুধু অবসাদ ও কুয়াশা...সেই কুয়াশার ভিতর তরু সন্ধ্যাতারা হয়ে আছে।

……………………………………………………………………………..o…………………………………………………………19/07/08