এখন রাস্তা চলতে চলতে মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়াই , দেখি সামনে যেন একটা চুনকাম করা দেওয়াল—ঠিক চুনকাম করা দেওয়াল , আর কিছু না ! শুনতে পাই প্রতিপক্ষরা হাসছে—একটানা খ্যান খ্যানে—অবিকল অবনীর মতো অথবা—“না ! কিছু না আর !”—নিশ্চই অবনী ; না হলে এমন পেটের সমস্ত নাড়ি ভুঁড়ি জড়িয়ে উঠে এসে মুখের দুই কশ বেয়ে গড়িয়ে নামে তৈলাক্ত একপ্রকার শব্দ অভঙ্গুর পিচ্ছিল—যদিও তা হাসি ! এবং তা অবনীর ! অবনী আমার প্রতিপক্ষ !
সাল ২০০৮ এর কলেজ ইলেকসান—আমার অধগতির সরলরেখার সূচনা যা কিনা অবনী ক্রমাগত উল্লম্ব ভাবে খন্ডিত করে ! যেন সাপ লুডো—অবনী মইয়ের উপর থেকে ক্রমাগত হাসছে ! বামুনের ছেলে , উন্নত নাসা তার ডায়াসের উপর রমণীমোহন ভাষন—আমার মাথার ভিতর ক্রমাগত দ্বেষ—উদ্ধত পাপ—দরমার ঘরথেকে উঠেআসা তেলাপোকার গন্ধ—খিদে যা কিনা কেবল মাত্র একটি শাদা দেওয়াল এখন,ঘোরের মতো আমার সামনে সামনে হাঁটে—কিংবা তার পিছনে পিছনে আমি! আর তিস্তা । তিস্তা বসু ! তার কলো চোখ, কালো গায়ের রঙ—শাদা হাসি—আমার শারিরীক পাপ, আমার রাজনৈতিক পরাজয়—আর শাদা দেওয়াল—যা খাদের পাশ থেকে উঠে গিয়ে সোজা আকাশ ছুঁয়েছে । মাঝে মাঝে মনে হয় টাল খেয়ে পড়ে যাব কি ? তবু সীমহীন দ্বেষ ,প্রতিশোধ নেবার বাসনা—এক অন্ধকার পথের শেষ বিন্দুতে পৌছালে যদি একান্তই বিবেকের দিকে তাকাতে হয় তা হলে তা পায়ের মাটির প্রতি অন্বেশন এই আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রতিবিম্ব ছায়ার মতো অনুসরন করে অথবা ঘড়ির মতো টিক টিক—দিবারাত্রি—পুতুলের মতো নাচে তখন সারা পৃথিবী !
রুমাকে আমি প্রথম দেখি—কিংবা বলা ভাল আবিস্কার করি ক্যান্টিনের পিছনে অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ন এক ছায়ান্ধকারে—সিগারেটের ধোঁয়া—সঙ্গে দেবেশ !
দ্বিতীয় বার দেখি দেবেশের বাড়িতে—আর সেটাও এক মহেন্দ্রক্ষন যাতে আমি ঠিক ঠিক করে রুমাকে আবিস্কার করি—সম্পূর্ন এক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে—ঠিক জীবনে প্রথমবার চশমা সহযোগে বিশ্বদর্শনের মতো । মনে হয়েছে রুমা ধীরে ধীরে দ্রবীভূত হবে দেবেশের ভিতর আর আমিও খল্ খল্ হেসে ইঁট গেঁথে যাব দেবেশের চারপাশে—যে দেবেশ তখন ক্রমশ শক্ত হচ্ছে প্রতিপক্ষ হিসেবে—যদিও দেবেশ কে কখনো শ্রেনীশত্রু মানতে পারিনি ; কারন তারও ভিতর অন্ধকার,তেলাপোকার গন্ধ—ধানের মরাই ভেঙে নিয়ে ইঁদুর চলে গেলে সেও প্রবীন চাষীর মতো মাথায় গামছা বেঁধে পোকাকাটা ফসলের পাশে বসে—আলের পাশে বসে ।
শ্রেনীশত্রু না হলেও দেবেশ তখন বিরোধী পার্টির মাথা হয়ে উঠছে । তার উত্তরনে ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না কিন্তু মাটি হারানোর যে ভয় যা একপ্রকার ক্ষুধা ও হতাশা থেকে জাত—এই অভিনিবেশ সহকারে প্রত্যক্ষ কৃত দেবেশের উত্তরন ভয় বইকি ! বিশেষ করে ক্ষুধা যার মূলধন এই পার্টিবিশেয বানিজ্যে আমার মতো তাদের প্রতিপক্ষ মানেই সাপ সে ক্ষেত্রে লাঠি না ভাঙার ব্যবস্থা সচল রাখতেই হয় ।
রুমা তখন এক নধর মাংস পিন্ড বই অবিকল আর কিছু নয়—শুধু লোভ—যেন ঘুরে বাড়ায় আমার চার পাশে—চোখ খুললেই তাই দেখি , অথবা চোখ খুললেই মনে হয় নাকের উপর চশমা চড়িয়ে বসে আছি যদিও চশমা পরাকে আমি আপাতত এক বুর্জোয়া অভিনয় বলে মনে করেছি অথচ এসবকে অর্থহীন প্রলাপ বলে আমিও মানি , কিন্তু সংস্কার ? সংস্কার কে কখনো আমি আমার বহিরঙ্গে রাখতে পারিনি এবং মাঝে মাঝে যার জন্যে আমার অহঙ্কার ও হয় ! যেমন সহবাসের সময় আমি প্রথমে বামস্তনে হাত রাখি—এ যেন বামপন্থার কাছে আমার সংস্কার ধর্ষিত নতিস্বীকার যার জন্যে আমি ক্ষনিক গর্ব বোধ ও করি ! তবে সংস্কার ধ্বস্ত চশমা সহদর্শনে আমি রুমার খিদে যা কিনা যাবতীয় পাপের মূলধন মানুষের , আমি তা লক্ষ করি আর মনে মনে হাসি শিকারী জন্তুর মতো ।
রুমার বাবা মারা যাবার পর তাদরে সংসারের হাল কি ভাবে চলছে এ সব জীবন দর্শনের অনুসন্ধানে বা চুলচেরা বিশ্লেষনে আমার কি প্রয়োজন ? বরং যেটা দেখার সেটা দেখা গেল !
গ্রামে এ রকম অনেক বদনাম রটে—রুমার মা কি ভাবে সংসার চালাচ্ছে তারও অনেক গল্প শোনা গেল—ক্লাবের রকে—আমি শুধু ভদ্রলোকের মতো কানে আঙুল দিয়ে কিছু টাকা গুঁজে দিলুম রুমার হাতে—বল্লুম—“আরো দেবো ।“
রুমা বুঝল !
তারপর বহুবর্ন বুদবুদ ক্রমশ বাতাসে ভেসে বেড়ায়—বড় হয়—ছোট হয় আবার কখনো অকারনেই সূর্যালোকে অপূর্ব বর্নচ্ছটা রেখে—আপনাকে বিনষ্ট করবার আহ্লাদে বিলুপ্ত হয়ে যায় !
যেমন দেবেশের সাইকেল—তার রঙ বদল যা কিনা ক্যারিয়ারে অঙ্গীভূত রুমার নিতম্বের উত্তাপের মতো অর্থপূর্ন তথাপি দেবেশ ও তার মায়ের অর্থনৈতিক কলহের মতো বাস্তব !
দেবেশ প্রথমবার রুমাদের বাড়ি যায় আমার সঙ্গে ! অনেক রাত , দেবেশ হো হো করে হাসে—যেন বুকের দালান বাড়িতে কেউ সব জানালা দরজা গুলি খুলে দেয় , সেখানে সেই অট্ট হাসির পৌরুষে প্রেতের মতো রুমার ক্ষীন স্বৈরিনী হাসি সঙ্গ দিতে গিয়ে ক্লান্ত হয় যেন ক্লান্তি কিছু দাবদাহ , তাপ জর্জর যৌবনের কাছে নতজানু হয়ে ক্রমশ আবার মাথা তুলে দাঁড়ায় উৎসারিত এক অন্ধকার কল্লোলের দিকে—যে অন্ধকার বেদনাকে আর্থিক অভাবের সুমুখে আয়নার মতো দাঁড় করিয়ে অনবরত নিজেকে প্রতিবিম্বিত করে ডুবতে থাকে—ভাসতে থাকে তা রুমার হাসিকে প্রায়সই ম্লান করে; অপুষ্টির মতো রুমার শরীরকে শীর্ণ করে যা নারকেলের পাতা আবার বিরক্তিহীন বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে যে বাতাস আমি আমার স্বার্থপূর্ন মুখ বন্ধ খামে রুমার চার পাশে ছড়িয়ে দিতে থাকি !
সেই শুরু ; তারপর দেবেশ শুধু সিড়ি দিয়ে নামতেই থাকে! কলেজ কামাই বাড়ে , ওদের পার্টির মিটিঙে দেবেশ থাকে—রুমা থাকে ! সেসব পার্টির আলোচনা দুই ভ্রু-দ্বয়ের অদ্ভুত ভঙ্গিমায় রুমা আমার কাছে ব্যক্ত করে যখন দুপুরে ; আমি রুমার ঘরের ভিতর উষ্ঞতা টের পাই তখন—সে উয্ঞতা মাঝে মাঝে আলোর মতো বিকিরিত হয়ে চোখ ঝলসিয়ে দেয় আমারও; রুমা চিরুনি হাতে আয়নার দিকে ঘুরে দাঁড়ালে—চার ধারের ড্যাম্প দেওয়ালের ভিতর থেকে যেন চামচিকে বেরিয়ে আসে একরাস অথবা তারা সব রুমার নাইটির ভিতর থেকেই যেন বেরিয়ে আসে—পিছন থেকে ঘাড়ের কাছের নাইটির আধুনিক লেসের ফাঁস খুলে দিলে; সে সব আমার দুই হাত করে—যদিও তারপর চামচিকের গন্ধে মনে হয় যেন বহু প্রাচীন অন্ধকার এক ফসিল শরীর রুমার ! সেই ফসিল শরীরে দেবেশ কৃত ক্ষুধার্ত ক্ষত রুমার অসহায় চোখ যেন আমায় আঙুল দিয়ে দেখায় অথচ এই সব দেখার দুপুর থেকে আমি অনবরত পালাতেই থাকি কিন্তু পা আটকে থাকে কোথাও ! ক্ষমতার এ এক রাজনৈতিক আঠা !
দেবেশ বোকা নয়, কিন্তু তার সমস্ত মন ও মানসিকতা এক প্রাচীন বৃদ্ধ উটের মতো গমন অনীহায় স্থবীর—শুধু নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকার বাসনায় সে মাঝে মাঝে কোথাও উধাও হয়ে যায় অথবা এই পলায়ন বৃত্তি কখনোবা রোম্যান্টিক—অযাচিত কোন মরুদ্যানে ক্ষুদ্র জলউৎসে কিছু গুল্ম যেমন আকৃষ্ট হয়ে ক্ষনিক উল্লাসে বাতাসে পত্রবিলাস করে—সেই তাৎক্ষনিক আহ্লাদ মগ্ন দেবেশ দীঘার সস্তা হোটেলে হৃদয়বিহীন এক তাপজর্জর আদিমতায় রুমাকে আহৃত করে রাখে যে রুমা কখনো মনোল্লাসে কখনো শরীর মগ্ন তবু হৃদয়ের কোনো গভীর জলাজমিতে সে দেবেশের পদচিহ্ন অবলোকনে আনমনা এক স্বপ্নে বিভোর হয় কখনো, যে স্বপ্ন এক রাজকন্যার, তার অন্তরীন থেকে মুক্তি হবে একদিন ; কিন্তু দেবেশ রাজপুরুষ হতে পারে না, যদিও এসব ক্রীড়া ভঙ্গিমার অভিনয়ে রুমা তা বোঝে অথচ স্বপ্ন তাকে ঘুনপোকার মতো কুরে কুরে খায় ।
কলেজ ইলকেসানের মনোনয়ন পত্র জমা দেবার দিন চলে যায় , দেবেশ ফেরেনা , তার দীঘার সমুদ্র বড় বেশী গভীর;তাই বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় জেতার যে সম্ভবনা ছিল আমার তা হঠাৎ বিনষ্ট হল অবনী মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ায় ।
অবনীকে সেই প্রথম দেখলুম যদিও কলেজে সে ছিল তবু এর পূর্বে কখনো তাকে দৃষ্টি গোচর করবার অভলিাষ অনুভব করিনি ।
অমার জয় ব্যাপারটা ছিল সময়ের অপেক্ষা । ফল প্রকাশের পর দেখাগেল হাওয়া ঘুরছে ; যে নিরঙ্কুশতায় জেতার কথা ছিল তা হল না, কিছু ক্ষত রেখে গেল আমাদের চারপাশে । অবনী কাঁটার মতো গেঁথে রইল আমার ভিতর ।
সেই প্রথমাবধি অবনীর ছায়া যেন আমাকে অনুসরন করে শেষে অতিক্রম করে যেত চায় যেমন এক ব্রীড়াবনত
পরগাছা লতা মহিরূহ আকর্ষন করত পাকে পাকে নিজকে বেষ্ঠিত করে সূর্যালোকের দিকে এগিয়ে যায় ; অবনীও তেমনি দুশ্চিন্তার ছায়া রূপে সুকৌশলে আমাকে আবৃত করে থাকে অথবা এ আমার নিজেরি স্বকল্পিত মনপীড়া যা শুধুই ভাবিত করে যে হাওয়া ঘুরছে জদিও সেসব সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সুঠাম রেখায়িত হয়ে স্থূল বক্তব্য রাখে যে ক্ষমতাশীলদের কাছ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে—অথচ সেসব দূরের আদর্শগত সৌখিনতা—আমাকে উত্তেজিত করার কারন কখনোই নয় কেননা আমি নিতান্তই স্থানীয় ক্মমতা সন্ধানী এবং যার ভতির কোন আদর্শের মাড়িপীড়া নাই , এ নিতান্তই এক ক্ষুদ্র স্বার্থ গৃধ্নু নিকষ তরঙ্গ যা আদপে রুজি রোজগার বই কিছু না—তবু ক্ষমতা ভোগের অভ্যাস ক্রমাগত বুনন বসত উত্তেজিত হতে থাকে ।
এ উত্তেজনার কালে তিস্তা এল কলেজে । নতুন বেনো জলের মতো একরাস ছেলে মেয়ে নতুন সেসানে যেমন আসে প্রতি বছর ; তিস্তাও এল তাদের ব্যাচেই ।
তার তাম্রবর্ন অঙ্গের অপরূপ সৌস্ঠব সুষমা নিভৃতে পদচারনা করে শেষে ধুপের সুবাসে রমণীয় রেখার দেহধারনে যেন ব্যস্ত হয়ে আছে—যদিও এশ্যাম মুখমন্ডলে তার শাদা আসি সর্বদা প্রজাপতি হয়ে ওড়বার মানসে স্ফূরিত হয় যেন সূর্যও তার আজ্ঞাবহে নিজের ঔজ্জ্বল্য প্রকাশের আগে দুই মুহূর্ত ভেবে নেয় তথাপি আমার এ চিত্রার্পিত ভাব অশোভন তবুও হঠাৎ মনে হয় কোথাও বৃষ্টি হয়েছে বেশ—এখনো অনাবিল গন্ধ আছে ফুলেরও ।
“তিস্তা কেমন আছো ?”—এই সামান্য একটি বাক্য যেন আমার মুখ নিসৃত লালা অসাবধানে—সহসা লজ্জিত, বুকের ভিতর বিন্দু বিন্দু ঘাম—“ এ কেন ? “ ;আমি নিজের দিকে তাকিয়েই চমকিত—এ বঙ্কিম সঙ্কোচ , যেনবা তালভঙ্গে হঠাৎ বিমূঢ় শিল্পী, আমার দৃষ্টিগোচরে তিস্তার দুই বক্র ভ্রুর বিলাস সুলভ কটাক্ষ আমার উল্লম্ব রেখায়িত শরীরে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে গিয়ে কিছু অন্বেষন—তার শোভিত কামিজের অন্তরালে দুই পক্ষিশাবক বুক মৃদু—অথচ অস্থির নিশ্বাসে কম্পিত, যে কম্পন তার তীখ্ন নাক অবধি এসে কুঞ্চিত ঘৃনায় আবিষ্ট; তার হাত অস্থির দ্রুততায় বুকের কাছে উঠে এসে ওড়নার ভাঁজ পুনরনির্মান করে ফের নিস্তেজ—অথচ তার মুখ—অধর তক্তিতার বিষাদ সঞ্জাত ক্ষনিক—
“রজনীববু........! “
তার স্বরক্ষেপ কিছু খাদের দিক থেকে সূচিত হয়ে উত্তোরন পর এক বিস্ময় পূর্নচ্ছেদে গিয়ে শেয হয় ।
তিস্তার আরো কিছু কথার তরঙ্গ অপেক্ষায় থেকে—মৌন ক্ষনিক, সহসা অবনী আসে করিডোরে—তার সরসা চেহারা উন্নত নাসা,উদ্ধত গমন ভঙ্গি—এক হীনমন্যতা যেন গাছের ডালপালার মতো আমার সামনে আন্দোলিত হতে থাকে, তার নিহিত নঞার্থক আবেশ—ক্রমশ যা কুঞ্চন সৃষ্টি আমার মানসিকতার ভিতরে তথাপি এ সবই অন্তসলীলা,অবনীর কাছে নিশ্চিত বিলুপ্ত ।
সে তার সুশ্রী অবয়বে যেন এক ব্যঙ্গের স্তর পরস্পর সজ্জিত করে বলে—“রজনী তোমাকে আজকল দেখিনা কলেজে.....! “ কথাগুলি যেন আরো দীর্ঘক্ষন প্রলম্বিত করে আরো কোনো কথার সঙ্গে যুক্ত হবার মানসে হঠাৎ তা সমাপ্ত, যদিও কথাগুলি নিতান্ত উদ্দেশ্যহীন, অবনী যার কোন উত্তরের প্রত্যাশা করে না ।
সে তিস্তার দিকে ফের যা প্রত্যাশিত ভাবে খুব সুস্থির এবং স্বাভাবিকও বা ; তখনি তার হাসি ঠোঁটের চারপাশে ক্রমাগত ছড়িয়ে যেত গিয়ে অনাবিল—
“তিস্তা তুমিও আসছ তো ? এসো.......”
ওরা দুজনে করিডোর পেরিয়ে গেল দ্রুত পায়ে । আমি ওদের যাওয়া দেখলুম । বুঝতে পারছিলাম ওরা কোথায় যাবে—ওদের পার্টির মিটিং আছে । বুঝলুম তিস্তাকে ও ।
এ বোঝা ঠিক রাজনৈতিক নয়—বহুদিন পরে অরাজনৈতিক কোন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু দেখলুল—দেখলুম মাঠরে পর মাঠ কীট আক্রান্ত ধানের ক্ষেত যেমন একদা—এখন শুধু খড়—হিম অস্থির হাওয়ায় ক্রমাগত আন্দোলিত—অথবা হাওয়া মুখ লুকায় উটপাখির মতো খড়ের ক্ষেতে—দৌড়ায় এ মাঠ সে মাঠ—অবিরত খস খসে—যেন হাওয়া ঘুরছে—তার অভিমুখ বদলে যাচ্ছে; একি ঐতিহাসিকতা ? এ কি মরা ফসলের ক্ষেত আবার ? আর তখনি প্রথম আবিস্কার করি এক শাদা দেওয়াল—আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমায় দেখছে; আমার সামনে সামনে হাঁটছে ।
তিস্তা যেন সেই দেওয়াল পেরিয়ে ধানক্ষেতরে দিকে আসে পাখির মতো অঢ়েল হাওয়ায়, তারপর দীগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় যেমন জলের তরঙ্গ—পুকুরে মৃদু কম্পন তার ক্ষনিক তথাপি কচ্চিৎ হাতে প্রলোভন নিয়ে ডাকি যদি—তবে হাসি তার অন্ধকারে তরঙ্গতুলে এক বক্র একাকিত্ব বুনন করত খিল্ খিল্—উধাও দূরে এক ঝাপসা ক্রন্দসী—সেথা বিন্দু বিন্দু ঘাম সিক্ত কামার দিবা রাত্রি—অথচ গোচরে তার কপোল লগ্ন অপরূপ তিল—মাঝরাতে ক্ষুধার মতো অন্তহীন বিষাদ—সেখানে বালি ঘড়ি ঝুর্ ঝুর্ করে অবনী হাসে—তার দুই কষ বেয়ে গড়িয়ে নামে অনর্গল হাসি ।
তর হাসি ধূর্ত মারীচ তুল্য ক্রমাগত উত্তেজিত করে তা হোম-অগ্নি—প্রলুব্ধ করে প্রতিষোধস্পৃহা যা আরো একবার রুমার মৃত্যু—ক্রুড় মনে হয়—“ক্ষতি কি ?”
দীঘা ফেরত সেবেশ কে আর দেখিনি আমি—অথবা দেখেছি তা স্মরনঅতীত ; সে কলেজ ছেড়ে দেয়—শহরে যায়—কারখানায় কাজ করে ; রুমার মুখে কিছু শুনে থাকতে পারি,যদিও তারা সব প্রয়োজনহীন—প্রসঙ্গহীন এখন, তবু খবর আসে কিছু ঘিন্ ঘিনে মাছির মতো—উড়ে বেড়ায়—এখন চরাচর জুড়ে অজস্র মাছি খবর যারা নিতান্তই বাহুল্য সৌখিন সময়ে ।
অথচ রুমার মৃত্যু ক্ষনিক ক্লেশ , অন্ত:সত্ত্বা কালীন তার গুলোট কান্না—দেবেশ ফেলে পলায়িত—আরো নিদারুন অভাব আর্থিক কিছুবা ,আমি স্বেচ্ছায় রুমার বাড়ীর পথ ভুল গেলে—অধিক ত্বরান্বিত ; অন্তিমে শুধুই এক পলিথিন আবৃত লাশ—ভ্যানট্রলিতে পড়ে থাকে সারাদিন থানার রোয়াকে ।
অথচ কতো সহজ তা—কদাচ কারো মনে হতে পারে জ্যাক রিপার ধরা পড়েনি কোনদিল—তার মৃত্যু হয়না—তার উত্তরাধিকার এক দেশ থেকে আরো এক দেশে ছড়িয়ে পড়ে;ওই সব চিল—ওই সব শকুন—এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশ অতীক্রম করে যায় অবহেলায় !
তিস্তার সব খবর আমি পাই—অবনী তখন গৌন—বুঝি রাজনৈতিক পরাজয় কখনো শাশ্বত নয়; হাওয়া ঘোরে—আবার ঘুরে আসে—ফিরে আসে তা ;কিন্তু তিস্তা ? বরং এক ঢ়িলে দুই পাখি !
ওদের পুরো ব্যাচ পুরুলিয়ায় যায় কলজে ট্যুরে । আমি আর কয়েক জন খবর নিয়ে ওদের কাছা কাছি এক লজে উঠি । সব কাজগুলো বড় অবহেলায় করছি আমি যেন এক অভিনয়—বড় অনায়াস কোন বিবেকের তরঙ্গ নেই অন্ধকারে—শুধু চলতে ফিরতে এক শাদা দেওয়াল—ঠিক চুনকাম করা ।
খবর পেয়েছি সন্ধ্যাবেলা তিস্তা আসবে—কাঁসাইয়ের চরে—অবনী আসবে ।
অভিনয় এর পর খুব সহজ—যা ঘটবে তার সব দায় তখন অবণীর ।
সন্ধ্যায় নদীর চরে ভিজে ভিজে বাতাস ওড়ে—চাঁদের আলো ঈষৎ জলের উপর যেন বিন্দু বিন্দু স্বদে , বাতাসের ঘায়ে তাদের ক্ষনিক প্রমত্ততা যেন নিষাদময়ী ধূসর প্রহেলিকা অদৃশ্য পিম্জরে অবদ্ধ—অনবরত তার ডানার ব্যাজন—ঈষৎ হিম আবেশ ক্ষনিক চমকিত—চমকিত তিস্তা—সর্ব্বগঠনে অপরূপা , চুল উড়ে মুখ ঢাকে ক্ষনেকে—পরিপাটি বস্ত্র বাতাসে শিথিল এলোমেলো , তার দুই হাত এয়ো-স্তীর পারিপাট্যে দেহ ঢাকে বার বার , মুখমন্দলে ভ্রুকুটি—অনবী আসে না,সে তখন আমার এক বন্ধুর সাথে আধো মদ্যপ, আলোচনায় ব্যস্ত অথচ তার মধ্যে উৎসুক ত্বরা-তিস্তার মিস্ কল আসে—তিস্তা ভয়ঙ্কর চমকায়—“তিস্তা কেমন আছো ?”—আমার স্বর প্রাগৈতিহাসিক গাঢ় ফিস্ ফিস্ !
“কি চাও ?”—তিস্তার ঠোঁট চিৎকারের ভঙ্গি করে থামতে বাধ্য—আমার হাত তার মুখ চেপে ধরলে পর তার সমস্ত শরীর রমনীসুলভ ভীষন অস্থির—তুমুল বক্ষদ্বয়—অপ্রকৃতিস্থ—কম্পিত,শ্বাস রুদ্ধ—হাত ছাড়িয়ে ফিস ফিস—“আমাকে চাও?”...”আমাকে চাও?’’ স্বরক্ষেপে পীড়িত আর্তি ; সে পলায়িত চপল নয়, থলকে দাঁড়ায় ; ভীষন দ্রুত তার হাতের সঞ্চালন—চাঁদের আলোয় তার এক এক বস্ত্র খসে পড়ে—কবরী মোচন করত তার হি হি হাসি—প্রলাপ—উন্মুক্ত পীনস্তন দ্বয়—নিষ্ঠুর বক্র ব্যঙ্গ—“আমাকে চাও?”—বাতাসে ধাক্কা খেয়ে প্রতিদ্ধনীত—তথাপি আমি পিরামিড স্থবীর—আমার দুই পা যেন ক্রমশ বালিতে প্রোথিত—আমি খাদের ভিতর নিমজ্জিত—চারিদিকে বালি ধ্বস—শাদা দেওয়াল যেন আমায় ঘিরে ধরতে থাকে—অপরিমেয় গহন এক খাদে আমি—আমার শাদা দেওয়ালে সবুজ শ্যাওলা—আঁশ গন্ধ—মুখ আর্তির মতো ভঙ্গুর—চাঁদের আলোয়—তিস্তা দৌড়ায় , তার প্রতিনীর মতো খোলা চুল—প্রলাপ-হি হি হাসি—“তুমি হিটলার হতে পারো না......পারবে না “—হি হি হাসি ,তার পা যেন মাটিতে পড়ে না—দূরে সে ভেসে যায় যেন ভিজে বাতাসে অথচ আমি মুঠিটে বাতাস ধরতে গেলে শুধু মুঠো মুঠো বালি উঠে আসে হাতে !