Search This Blog

Saturday, December 4, 2010


 বৃষ্টি ডানা

ঝির ঝির বৃষ্টি ।বৃষ্টিপাতের সঙ্গে মিলেছে ঝিঝির ডাক সেই সঙ্গে তার মনোবিলাস ; কোথাও সমাপতনের মতো করে দু-একটা ইট ধসে পড়ে, দেওয়াল ধ্বসে পড়ে, এ সব কান পেতে শোনা না মনোবিভ্রম ? যা বঙ্কিম ভ্রু উঁচিয়ে দ্যাখে, মাথা নাড়ে, হাতপা নাড়ে তারপর ছায়ার দিকে সরে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ! তোড়া রাত্রে খেতেবসে এ সব ভাবে! একাই খেতে বসে, বাচ্ছাটাকে খাইয়ে দাইয়ে দিয়ে দোলায় শুইয়ে দেয় আগে তারপর সে রান্নাঘরে আসে। তার শ্বশুর মাঝে মাঝে দোলনায় একটু দোল দেয়, শশুড়ি ফিস্ ফিস্ করা কথা বলে –তোড়া রান্না ঘর থেকে আবছা শুনতে পায়—দেওয়ালের গা বেয়ে বেয়ে সে কথারা মাকড়সার মতো চলে বেড়ায়। প্রথম প্রথম তার ভয় করত, পোড়ো বাড়ির মতো বহু পুরানো বাড়ি—গলি ঘুঁজিতে থিক্ থিক্ জমে থাকা অন্ধকার—সেই অন্ধকারে কারা যেন হেঁটে বেড়ায়—এমনো মনে হতো তার, মনের ভিতর কিছু পরস্পর সংলগ্ন ভয়—দশ আঙুল মেলে মাকড়শার জাল বোনে—আর কথার খেই হারিয়ে গেলে শ্বাস বায়ুর অভিঘাতের মতো কথার অভিনয় করে চলে ক্রমাগত যেন আবছায়ার দিকে বসে কেউ খুক্ খুক্ কাশে ! সে বড় বিশ্রী ব্যাপার তখন একা একা খেতে বসা । শ্বশুর-শশুড়ি আগে খেয়ে নেয়—সামান্য যে টুকু তদের আ্হার ; তর অনেক পরে হ্যারিকেনের আলোয় দীর্ঘ ছায়া ফেলে সে যখন রান্না ঘরে আসে তখন গা ছম্ ছম্ করে । মনে হয় লাঠি হারিয়ে কোনো অন্ধ মানুষ যেন অবিরত হাতড়ে বেড়াচ্ছে ।
     কিন্তু এখন আর তেমন মনে হয় না বরং একা খেতে বসা একটা বিলাস—অনেক সময় নিয়ে, চার পাশে যেন অঢেল সময় হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকে ! সে ভাবে আকাশ পাতাল, ঝিঝির ডাক শোনে—শীতকাল বলে দূরে শেয়াল ডাকে, কুয়াশা হাতড়ে হাতড়ে সে ডাক যেন রান্না ঘরের দাওয়ায় এসে থমকে দাঁড়ায়; ভয়ের কথাই তা ! কিন্তু যার ভবিতব্য এভাবেই কোল পেতে বসে থাকে তার একদিন ভায় কাটে বইকি ! তোড়াও এতদিনে এদের সঙ্গে হতে হাত রেখে বসবাস করতে শিখে নিয়েছে !একটা বড় দা সে বাসনকোসনের মতো করে রান্না ঘরের তাকে সাজিয়ে রাখে, সেটা হাতে নিলে তার সারা গা শক্ত হয়ে যায়—বাইরের ঘরের জানালায় অকারনে যখন টোকা মারার শব্দ পায় তখন রান্না ঘরের মৃদু আলোয় তার ছায়া যেন আরো দীর্ঘ হয়ে যায়—নিবিড় অন্ধকারেরও যেন সীমানা ছাড়িয়ে যায়, ছায়ারাও সে সময় কানে ফুসমন্তর দেয়—যে বাড়িতে সমর্থ পুরুষ নেই সে বাড়ির কড়া বাতাসেও নড়ে ।
     তোড়ার কানে এই সকল শব্দ এখন নিমিত্তের মশা মাত্র, তারা ক্ষনিক গুন গুন শব্দ তুলে ফের অন্ধকারের দিকে মিলিয়ে যায়, মিলিয়ে যায় কেননা সে—তোড়া এই সমস্ত শব্দের প্রহার পরিহার করে আজকাল ! সে থাকে আহারের বিলাসে মগ্ন—দীর্ঘ ক্ষন; চর্বিত চর্বন তার নানাবিধ চিন্তা ঘুরে ফিরে নানা দৃষ্টিকোনের অনুপাতে দংশন করে যায় ! তবু সে ভাবনাগুলোকে কোলের কাছে জড়ো করে রাখে যেন এক মমতার খেলা চলে তাদের সাধে তার । পা ছড়িয়ে সে তাদের সঙ্গে বসে—মনে মনে দু-চারটে কথার ফুলকি ওড়ে, বাতাসে ভাসে, রংমশালের মতো কখনো তারা রঙিন, কখনো অন্ধকারে দু-একটা জোনাক জ্বলে—নেভে, অথবা পাশাপাশি তারা বসে থাকে তোড়ার আসে পাশে, কি ভীষন মায়া চিত্রন করে যেন তারা একাকী তোড়ার চারপশে অন্ধকার, চরাচরে !
     রাতের দিকে তোড়া বিশেষ রান্না করেনা—দুপুরের তরকারি গরম করে নেয়; আর দু-মুঠো ভাত নিজের জন্য ফুটিয়ে নেয় !
     ছেলেকে নিয়ে বিছানায় যেতে যেতে তোড়ার সেই রাত এগারোটা ! পুচকেটা ততক্ষনে ঘুমিয়ে কাদা ।
     ছেলেকে বিছানা ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে সে যখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল খুলে বসে তখন এক প্রবল ভার যেন তার সারা শরীরে নেমে আসে ! আবার চারপাশের ভাবনা গুলো প্রসাধনের মতো মাখতে থাকে সারা গায়ে—চুলে বিলি কাটে ।
     সুমিত ঘরে থাকলে সে এভাবে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল খুলে বসেত না—সে পায়চারি করে বেনী রচনা করত হেসে—“আমকে কেমন মানাচ্ছে বলো তো?”—কথায় আহ্লাদ দ্বি-প্রহরের রৌদ্রের মতো আভা দেয়—তার চোখের দ্যুতি প্রহারে অভিসিক্ত করে সুমিতকে ব্যতিব্যস্ত করে। সে সব খেলা বা বাতাসের স্বাভাবিক হিল্লোল—আজ তোড়ার মনে হয় নষ্ট পোকার মতো কুরে কুরে খায় ! কোথায় গাছের গাছের ডানায় মেঘ বৃষ্টি হয়ে মোমের মতো বিগলিত হয়ে নামে ? নামে আজো—তোড়ার বুকের ভিতর নিভৃতে কদাচিসুমিত এসে পড়লে ! কিন্তু এখন তোড়ার সারা গায়ে প্রবল ভার, যেন বর্ষার সমস্ত মেঘ পাহাড়ের মতো তার বুকে এসে জমেছে ।
     চুলে দুবার চিরুনি বুলিয়ে নিয়ে সে বসে ধাকে ঠায়—সেই রাত দুটো আড়াইটে  অবধি, “আয় ঘুম, আয় ঘুম” তার ঘুম আসেনা মোটে—মাধার ভিতর অনবরত  বিন্দু বিন্দু আগুনের স্ফূরন—তার প্রিয় গল্পের বই থেকেও বিরত করে তাকে; সে শরীরের বিপুল ভার নিয়ে উঠতে পারে না—স্থবীরতা তাকে বসিয়ে রাখে !
     কোনো কোনো দিন ছোট জা ফোন করে তাকে রাত্রের দিকে ! আগুনের ছিটে বর্ষায় যেন তার কানে—মাঝে মাজে তার অবাক লাগে—“ওরা ফোন করে কেন?অসময়ের অভিনয়কে কি প্রলম্বিত করার জন্যে?” কিংবা কিছুই না—অনন্য দুঃখের নির্মান সুখ !
     ছোট দেওর বড় অফিসার—সরকারি, তার কলকাতায় বাসাবাড়ি, গাড়ি, ঠাট, জমক অনবরত বিভেদের এক নোঙর সাজিয়ে রাখে—বলে—“তারা সব তোড়ার মাটির থেকে অনেক মাইল দূরে”।
     কখনো সখনো তারা গাড়ি হাঁকিয়ে দেশের বাড়িতে বেড়াতে আসে! যেন চার পাশে লক্ষ করে দেখে আগাছা কতো বড় হয়েছে !
     উপদেশের মতো করে তারা দুঃখ—টঃখ—ছাই—পাঁশ বর্ষন করে যায় !সে সময় শ্বশুর শাশুড়ি পর্ণোমোচী হয়ে যায়—রূপ বদল হয় তাদের হাবে ভাবে।
     সে কয়দিন তোড়ার সবকিছু নিঝুম মনে হয়—মনে হয় কোথাও একাকিত্বের দিকে অন্ধকার গাঢ় হয়ে গিয়েছে, মনে মনে বলে—“ভগবান আছেন , ভগবান আছেন” বাথরুমে যেতেও তার তখন ঘেন্না লাগে—সে বাথরুম তার দেওরের অর্থে বানানো, অথচ সুমিত কে বার বার বলেও “একটা বাথরুম বানিবে দাও, ভালো মন্দ যেমন তেমন”, সুরাহা দূর অস্ত, যেন সে কথা বারংবার দেওয়ালে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এসে মনোবেদনায় ক্লান্ত; তোড়া যদিও দিনের বেলা বাগানে যায়, কিন্তু রাত্রে সে বাগানে যেতে পারে না, ভুতের এক অলীক ভয়, বিছানায় কাঠ হয়ে সে পড়ে থাকে—ঘরের বাথরুমেও যায় না।
     সুমিত কারখানায় কাজ কারে, ছোট মোট কাজ, আসলে তার কাজের ইচ্চেটাই কম, শুধু তার বড় বড় কাথার ফানুস, তাইতেই সে আকাশে ভাসে—অন্যায় তর্কের প্রাচীর তুলে চোখ লাল, মুখ ভঙ্গিল, খাঁ খাঁ মাঠে রৌদ্দুরের প্রদাহের মতো তার কথা অসহ্য ! তোড়া তর্ক করে না, অবস্য তর্কের অভিলাষ তার কোনদিনই ছিল না, ছোট থেকেই সে শান্ত “বুক ফাটে তো মুখ ফোতে না” যদিও তার ভাবনা বা সিদ্ধান্ত অটল তাতেই চিরটাকাল সে একটা একলাটে, মেলামেশায় সে বসে বসে কথা শোনে, ঠোটের কোনে কোনে হাসে; এটুকুই, ভিতরের কথা তার বাইরে আসে না !
     বিয়েটা তাদের দেখাশুনা করেই, সুমিতও দেখতে গিয়েছিল, তার সম্মতিক্রমেই বিবাহ; তবু ফুলশয্যার প্রথম নৈকট্যে তোড়া বোধ হয় বুঝেছিল সুমিতের মনে কোথাও একটা অপচ্ছন্দের কাঁটা রয়ে গেছে ! আসলে সুমিতের পছন্দতাই কিংবা পছন্দ অপছন্দের বোধ বুদবুদের মতো, রোদে রামধনু রচনা করে নিমেশে ফুড়ু! সেই থেকেই তোড়া যেন এক কাঁটার ঝোপ সর্বদা কোলের কাছে নিয়ে ঘর করে—বসবাস করে ।ঘরের ভিতরে তার আগাছা বাড়ে কাঁটাঝোপের , বাইরে থাকে অলীক দেওয়াল।
আগাছা সব সুমিতের খেয়াল, বাদবিচার, তোড়া সেই খেয়ালের ঘুড়ির সাথে লেজের মতো জড়িয়ে মড়িয়ে একসা ।
     সুমিত আসলে তার মায়ের মতো, তোড়ার শাশুড়ি কথা বলে বেশ, কিন্তু কথার ভিতর হুল, হুলে বিষ জ্বালা !
     তোড়ার সবই আস্তে আস্তে থিতিয়ে যেতো , সয়ে যেতো হয়ত, পুচকেটা আসার পরে! তোড়া তেমনই আশার স্বপ্নে মগ্ন ছিল ! কিন্তু কোথা থেকে মাঝে মাঝে কিছু উড়ো হাওয়া এসে সে মগ্নতা কাচের মতো ভেঙে দিয়ে যায় ! তোড়া নড়ে চড়ে বসার অবসর পায় না, তার সারা দে্হ পাথরের মতো ভারি হয়ে যায় ।
     তোড়া তার সুদীর্ঘ চুলের ছায়া আয়নায়—অন্ধকারের আবছায়ায় প্রতিফলিত হতে দেখে ক্ষনিক শান্তি পায়—এই চুল খুলে আয়নার সামনে বসা—এ এক বিলাস তার, সেই বয়ঃসন্ধিকাল থেকে; যবে থেকে সে আয়নাকে বুঝতে শিখেছে, বুঝতে শিখেছে তার টিকালো নাসা, মুখের লাবন্য ও দীর্ঘ চুলের বিন্যাস , সেই উড়ো মেঘের বয়স থেকেই তার পড়াশুনা ছেড়ে আয়নার সামনে বসে থাকা এক আহ্লাদ, তবু তোড়া সুন্দরী নয় প্রকৃত অর্থে, তা হলেও এক লাবন্যের দ্যুতি প্রতিমার মুকে গর্জন তেলের মতো করে মাখানো—চোখে পড়ে , একটু মনোযোগে তাকালেই হল ! তোড়া সুমিতের চোখে সে মনোযোজ দেখে না !
     আজ সেই চুলও তার মনোবেদনার সঙ্গে মিশে ম্লান—প্রানহীন! খুব উঠে যাচ্ছে ইদানীং ! সুমিতকে সে বলেছে “জানো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, চুল উঠছে খুব!” সুমিত আজ নয়, কাল নয় করে হাওয়ায় ভাসিবে রেখেছে সবকিছু ।
     ইদানীং শুনেছে সুমিত কারখানার কাজ ও ছেড়েছে, ছেড়ে কি করছে তোড়া তা জানে না—তোড়াকে সে কিছু জানায়নি, জানাবার কোনো প্রয়োজন সে তার কথাতে হাসিতে প্রাকাশ করার অভিলাষ জ্ঞাপন করেনি, সুমিত নিজের ভিতরেই নিজে চিত্রিত করে নিয়েছে নিজের দিনযাপন ।
তোড়া এখন তার চোখের কাঁকর, অনবরত কর্ কর্ করে; অবিরত বিদ্বেষ ঢেলে চলে, তার ব্যবহারে; তোড়ার মনে হয় শুধু চোরের মতো সর্বদা অস্থির, চঞ্চল, মাছির মতো উড়ে উড়ে শুধু বিরক্ত করে।
পুচকেটাকেও কাছে টানে না, তোড়ার কোনো গভীর আকুতি “ওগো ছেলেকে দ্যাখো” যেন বন্ধ দেওয়ালে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে ফিরে আসে! অথচ তোড়ার শরীরে গোপন ভাঁজ—গভীর অন্দরের ভিতর সেঁদিয়ে যেতে সুমিতের উল্লাস বাধাহীন, তা কাঠ ঠোকরার মতো আহ্লাদে ঠুকরে যায়, আসলে চিরদিনই শরীরে তার অভিনিবেশ, তোড়ার শরীরও শুধু সেই পারস্পরিক প্রয়োজনের ভাস্কর্য যদিও তা শিল্পির কিংবা নির্মানের নয়, ভাঙনের; তোড়ার কোনো “এখন নয়” শোনে না, নদীর মতো এক পাড় ভাঙে, তোড়া তলিয়ে যেতে যেতে অভিমানের হিক্কার তোলে—“নাও, খাও খাও”!
     তোড়ার ভয় ছিল মাসের ঠিক সময় নয় সেটা; সেই বাসাবাঁধা ভয় একদিন প্রবল মনে হল,পিরিয়ড পিছিয়ে যেতে! তোড়া সে ভয়ের কথা কাকে বলবে?আসলে সুমিত আর চায় না, তাই ভয়! তাই ভয় ফনিমনসার ঝোপের ভিতর আটকে থাকার মতো শত্রুতা; এ ভাবে এই ভয়ের খেউড় শুনতে শুনতে দিন পেরিয়ে যায় বেশ কিছু।
শেষে যখন শরিরের ভিতর এক নদীর কল্ কল্ প্রবাহ—হাসি টের পায় তোড়া তখন সে সুমিত কে বলে;
সুমিতের এতো রাগ কখনো দেখেনি সে। সুমিত অনবরত ঝড়ের মতো ভেঙে পড়ে যেন তোড়ার উপর; সেই প্রথম সুমিত তোড়ার গায়ে হত তোলে।
     সুমিত ডাক্তারের কাছে যেতে চায়, কিন্তু তোড়া রাজি নয়, সুমিত মারধোর করে, রাগ করে, কিন্তু তোড়া অনড়; সে আরো বাঁধনে জড়াতে চায় সুমিতকে!কোথায় যাবে সে তোড়ার হাত ছাড়িয়ে? তোড়া তা হতে দিতে পারে না, যতই অধিকারের দেওয়ালগুলো ভেঙে পড়ুক; আর একটা প্রান স্পন্দন দিয়ে সে নিশ্চই সুমিতকে আগলে রাখতে পারবে! তাছাড়া কোথায় যাবে তোড়া?বাবার অবস্থা তেমন ভালো না—দুটো বোন আছে; তোড়াকে তাই এখানেই থাকতে হবে, ভালোবাসার নাম করে মিথ্যেকে বাঁচিবে রাখতে হবে ! তোড়া সেই স্বপ্নের আশায় থাকে—কখনো ভয় মাতব্বরি করে,তাসের ঘরের মতো ভেঙে দিতে চায় সবকিছু—সেই মাতব্বর ভয়ই ফুসমন্তর দেয় “তুমি না পেলে কিছু, সুমিতও কেন কিছু পাবে?”
     সেই ভয়ই এখন আয়নার সামনে বসে অন্ধকারে অভয় দেয়, আস্কারা দেয় তোড়াকে, পাথরের মতো চাপ চাপ সে আস্কারা—“সুমিত কিছু পাবে না, না পেলে.....”!
     তোড়া মুচকি মুচকি হাসে, তখন তার চুলে মুখের এক পাশে জানালা দিয়ে চাঁদের আলোর একটা টুকরো এসে পড়েছে!মেঘর ফাঁক দিয়ে একটুখানি ভাঙা চাঁদ—এখনি হয়ত মেঘে ঢেকে যাবে, বৃষ্টি নামবে, বৃষ্টি নামলে তোড়া গাছেদের পাহারা বাঁচিয়ে পরকীয়ায় মাতবে—সে ও তার মেঘ, তার দু হাতে বৃষ্টি ডানা , তোড়া আবার হাসে, শব্দ করে হাসে “পরকীয়াতে দোষ আর কি? সুমিত করছে যখন”! খবরটা কানাঘুষোয় শুনেছিল, আজ ভালো লোকের কাছ থেকেই খবর পেয়েছে, সুমিত আবার বিয়ে করতে চায় !ছোট জা ফোনে হাসতে হাসতে বল্ল “মরন, গলায় দড়ি জোটে না!”
     তোড়া আবার একটু হাসে, আয়নাতে নিজেকে এলো চুলে দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যায়, চোক ফেরাতে পারে না! তোড়া আয়নার ভিতর এক অচেনা মেয়ের প্রচ্ছায়া খুঁজতে খুঁজতে হাঁপিয়ে মরে, সুমিতের সঙ্গে তাকে কেমন মানাবে?
     হাসতে হাসতে বলে “কেমন?”
ভিতর থেকে মাতব্বর ভায় বলে “সুমিত কে যেতে দেবে?”
তোড়া মনে মনে বলে “যাক্” , এই বলে সে ভয়কেও মুক্তি দেয় তার ভিতর থেকে !
     সে নীচে থেকে শ্বশুরের ঘুমের বড়ির শিশিটা এনে রেখেছে, ভেবেছিল কাল সুমিত আসবে, তখন তোড়া দেখবে সে কি করে যায় তোড়ার হআত ছাড়িয়ে!
     তোড়ার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে ! তার মেঘ আছে, দুই ডানা বৃষ্টি আছে, সে বৃষ্টি হয়ে ঠিক মেঘেদের ভিতর ঢুকে যাবে; ভাবতে ভাবতেই তোড়ার গায়ে কাঁটা দেয়, তা কি আনন্দ না বিষাদ ! তোড়া পুচকেটাকে মগ্ন হয়ে দেখতে দেখতে, আরো অনেক্ষন দেখতে দেখতে, আকাশ পাতাল ভাবে, ভাবতে ভাবতে আলগোছে শিশিটার দিকে হাত বাড়ায় !
     বাইরে তখন দু চার ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে ।

                          
                          ----শেষ----

Tuesday, October 26, 2010

PALATAK



মাঝে মাঝে এমন এক একটা দুপুর আসে
ঘরছাড়া নানান দিনের ফাঁকে ফাঁকে—
হেমন্তের ক্ষয়াটে রোদ আর কাকের ডানার
ভিজে ভিজে রঙে বুড়ি ছোঁয়া করে ছুঁয়ে—
পালিয়ে যাব বলেও পালিয়ে যাওয়া হয় না !
একটা সময় ছিল যখন বাবার হাত ছাড়িয়ে
এ ভিড় সে ভিড় ছেড়ে দৌড়েছি ট্রামলাইনের
কাটাকুটির ওপারে !

তখন ছিল পালিয়ে যাবার দৌরাত্ম !

এখন প্রতি মোড়ে—মোড় ঘুরে দেখি পকেট উপচে
বিজ্ঞাপনের ছবি , ছায়ার মতন দীর্ঘ ছায়ায়—
আমারি ছায়ার মায়ায়—স্মৃতি খুঁজে যায়
অভ্রংলিহ অঙ্গুলি ; সংকেতে তার
সূর্য খুঁজেছি—মাঠে আর মিনারে—সিঁড়ির পাঁজরে—
রাস্তা পেরোই  প্রানের মাটিতে
তোমারি কাঁধে মাথা রেখে !

এই শহর দিয়েছে দুপুর , অপার জীবন—
তোমার আমার পথ চলার মানে !

Tuesday, October 19, 2010

CHUTI

ছুটি
অবিন সেন

মাঝে মাঝে কিছু পায়রা উড়ে আসে
এই কার্নিসে—সেমিকোলনের মতো
তাদের শরীর ঘ্রান আমার ছেলেবেলার দিকে
জানালা খুলে বসার মতো , ভ্রান্ত ,
তবু ক্যালেন্ডারে লাল দাগ—নদীর চড়ায়
ফুটবল, জলছবির মতো ভাবতে বসলে
নদী বলে—“আয়—আয়”....

এখনো তো কত নদীর দিন—ছুটি পরিবার,
পেরিয়ে যেতে গিয়ে পা ভিজে যায়—
শাদা কালো টিভিতে ম্যাটিনি শো—দুপুরের জার্নালে
একরাস শাদা পায়রা দিকচক্রবালে উড়ে গেলে
মাঝে মাঝে অচেনা মনে হয় এই ঘর-বাড়ী—
বৃষ্টিগান, শুধু মনে পড়ে এক অভ্রান্ত আলপথে
মাইলের পর মাইল সাইকেল টেনে টেনে বাবা ঘরে ফেরে ;

অথচ আজো ছুটির দিন—লাল কালি—
সন্ধ্যার চৌকাঠে এক ছুটি পরিবার !

PROTIPOKHO



এখন রাস্তা চলতে চলতে মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়াই , দেখি সামনে যেন একটা চুনকাম করা দেওয়াল—ঠিক চুনকাম করা দেওয়াল , আর কিছু না ! শুনতে পাই প্রতিপক্ষরা হাসছে—একটানা খ্যান খ্যানে—অবিকল অবনীর মতো অথবা—“না ! কিছু না আর !”—নিশ্চই অবনী ; না হলে এমন পেটের সমস্ত নাড়ি ভুঁড়ি জড়িয়ে উঠে এসে মুখের দুই কশ বেয়ে গড়িয়ে নামে তৈলাক্ত একপ্রকার শব্দ অভঙ্গুর পিচ্ছিল—যদিও তা হাসি ! এবং তা অবনীর ! অবনী আমার প্রতিপক্ষ !
সাল ২০০৮ এর কলেজ ইলেকসান—আমার অধগতির সরলরেখার সূচনা যা কিনা অবনী ক্রমাগত উল্লম্ব ভাবে খন্ডিত করে ! যেন সাপ লুডো—অবনী মইয়ের উপর থেকে ক্রমাগত হাসছে ! বামুনের ছেলে , উন্নত নাসা তার ডায়াসের উপর রমণীমোহন ভাষন—আমার মাথার ভিতর ক্রমাগত দ্বেষ—উদ্ধত পাপ—দরমার ঘরথেকে উঠেআসা তেলাপোকার গন্ধ—খিদে যা কিনা কেবল মাত্র একটি শাদা দেওয়াল এখন,ঘোরের মতো আমার সামনে সামনে হাঁটে—কিংবা তার পিছনে পিছনে আমি! আর তিস্তা । তিস্তা বসু ! তার কলো চোখ, কালো গায়ের রঙ—শাদা হাসি—আমার শারিরীক পাপ, আমার রাজনৈতিক পরাজয়—আর শাদা দেওয়াল—যা খাদের পাশ থেকে উঠে গিয়ে সোজা আকাশ ছুঁয়েছে । মাঝে মাঝে মনে হয় টাল খেয়ে পড়ে যাব কি ? তবু সীমহীন দ্বেষ ,প্রতিশোধ নেবার বাসনা—এক অন্ধকার পথের শেষ বিন্দুতে পৌছালে যদি একান্তই বিবেকের দিকে তাকাতে হয় তা হলে তা পায়ের মাটির প্রতি অন্বেশন এই আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রতিবিম্ব ছায়ার মতো অনুসরন করে অথবা ঘড়ির মতো টিক টিক—দিবারাত্রি—পুতুলের মতো নাচে তখন সারা পৃথিবী !
রুমাকে আমি প্রথম দেখি—কিংবা বলা ভাল আবিস্কার করি ক্যান্টিনের পিছনে অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ন এক ছায়ান্ধকারে—সিগারেটের ধোঁয়া—সঙ্গে দেবেশ !
দ্বিতীয় বার দেখি দেবেশের বাড়িতে—আর সেটাও এক মহেন্দ্রক্ষন যাতে আমি ঠিক ঠিক করে রুমাকে আবিস্কার করি—সম্পূর্ন এক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে—ঠিক জীবনে প্রথমবার চশমা সহযোগে বিশ্বদর্শনের মতো । মনে হয়েছে রুমা ধীরে ধীরে দ্রবীভূত হবে দেবেশের ভিতর আর আমিও খল্ খল্ হেসে ইঁট গেঁথে যাব দেবেশের চারপাশে—যে দেবেশ তখন ক্রমশ শক্ত হচ্ছে প্রতিপক্ষ হিসেবে—যদিও দেবেশ কে কখনো শ্রেনীশত্রু মানতে পারিনি ; কারন তারও ভিতর অন্ধকার,তেলাপোকার গন্ধ—ধানের মরাই ভেঙে নিয়ে ইঁদুর চলে গেলে সেও প্রবীন চাষীর মতো মাথায় গামছা বেঁধে পোকাকাটা ফসলের পাশে বসে—আলের পাশে বসে ।
শ্রেনীশত্রু না হলেও দেবেশ তখন বিরোধী পার্টির মাথা হয়ে উঠছে । তার উত্তরনে ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না কিন্তু মাটি হারানোর যে ভয় যা একপ্রকার ক্ষুধা ও হতাশা থেকে জাত—এই অভিনিবেশ সহকারে প্রত্যক্ষ কৃত দেবেশের উত্তরন ভয় বইকি ! বিশেষ করে ক্ষুধা যার মূলধন এই পার্টিবিশেয বানিজ্যে আমার মতো তাদের প্রতিপক্ষ মানেই সাপ সে ক্ষেত্রে লাঠি না ভাঙার ব্যবস্থা সচল রাখতেই হয় ।
রুমা তখন এক নধর মাংস পিন্ড বই অবিকল আর কিছু নয়—শুধু লোভ—যেন ঘুরে বাড়ায় আমার চার পাশে—চোখ খুললেই তাই দেখি , অথবা চোখ খুললেই মনে হয় নাকের উপর চশমা চড়িয়ে বসে আছি যদিও চশমা পরাকে আমি আপাতত এক বুর্জোয়া অভিনয় বলে মনে করেছি অথচ এসবকে অর্থহীন প্রলাপ বলে আমিও মানি , কিন্তু সংস্কার ? সংস্কার কে কখনো আমি আমার বহিরঙ্গে রাখতে পারিনি এবং মাঝে মাঝে যার জন্যে আমার অহঙ্কার ও হয় ! যেমন সহবাসের সময় আমি প্রথমে বামস্তনে হাত রাখি—এ যেন বামপন্থার কাছে আমার সংস্কার ধর্ষিত নতিস্বীকার যার জন্যে আমি ক্ষনিক গর্ব বোধ ও করি ! তবে সংস্কার ধ্বস্ত চশমা সহদর্শনে আমি রুমার খিদে যা কিনা যাবতীয় পাপের মূলধন মানুষের , আমি তা লক্ষ করি আর মনে মনে হাসি শিকারী জন্তুর মতো ।
রুমার বাবা মারা যাবার পর তাদরে সংসারের হাল কি ভাবে চলছে এ সব জীবন দর্শনের অনুসন্ধানে বা চুলচেরা বিশ্লেষনে আমার কি প্রয়োজন ? বরং যেটা দেখার সেটা দেখা গেল !
গ্রামে এ রকম অনেক বদনাম রটে—রুমার মা কি ভাবে সংসার চালাচ্ছে তারও অনেক গল্প শোনা গেল—ক্লাবের রকে—আমি শুধু ভদ্রলোকের মতো কানে আঙুল দিয়ে কিছু টাকা গুঁজে দিলুম রুমার হাতে—বল্লুম—“আরো দেবো ।“
রুমা বুঝল !
তারপর বহুবর্ন বুদবুদ ক্রমশ বাতাসে ভেসে বেড়ায়—বড় হয়—ছোট হয় আবার কখনো অকারনেই সূর্যালোকে অপূর্ব বর্নচ্ছটা রেখে—আপনাকে বিনষ্ট করবার আহ্লাদে বিলুপ্ত হয়ে যায় !
যেমন দেবেশের সাইকেল—তার রঙ বদল যা কিনা ক্যারিয়ারে অঙ্গীভূত রুমার নিতম্বের উত্তাপের মতো অর্থপূর্ন তথাপি দেবেশ ও তার মায়ের অর্থনৈতিক কলহের মতো বাস্তব !
দেবেশ প্রথমবার রুমাদের বাড়ি যায় আমার সঙ্গে ! অনেক রাত , দেবেশ হো হো করে হাসে—যেন বুকের দালান বাড়িতে কেউ সব জানালা দরজা গুলি খুলে দেয় , সেখানে সেই অট্ট হাসির পৌরুষে প্রেতের মতো রুমার ক্ষীন স্বৈরিনী হাসি সঙ্গ দিতে গিয়ে ক্লান্ত হয় যেন ক্লান্তি কিছু দাবদাহ , তাপ জর্জর যৌবনের কাছে নতজানু হয়ে ক্রমশ আবার মাথা তুলে দাঁড়ায় উৎসারিত এক অন্ধকার কল্লোলের দিকে—যে অন্ধকার বেদনাকে আর্থিক অভাবের সুমুখে আয়নার মতো দাঁড় করিয়ে অনবরত নিজেকে প্রতিবিম্বিত করে ডুবতে থাকে—ভাসতে থাকে তা রুমার হাসিকে প্রায়সই ম্লান করে; অপুষ্টির মতো রুমার শরীরকে শীর্ণ করে যা নারকেলের পাতা আবার বিরক্তিহীন বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে যে বাতাস আমি আমার স্বার্থপূর্ন মুখ বন্ধ খামে রুমার চার পাশে ছড়িয়ে দিতে থাকি !
সেই শুরু ; তারপর দেবেশ শুধু সিড়ি দিয়ে নামতেই থাকে! কলেজ কামাই বাড়ে , ওদের পার্টির মিটিঙে দেবেশ থাকে—রুমা থাকে ! সেসব পার্টির আলোচনা দুই ভ্রু-দ্বয়ের অদ্ভুত ভঙ্গিমায় রুমা আমার কাছে ব্যক্ত করে যখন দুপুরে ; আমি রুমার ঘরের ভিতর উষ্ঞতা টের পাই তখন—সে উয্ঞতা মাঝে মাঝে আলোর মতো বিকিরিত হয়ে চোখ ঝলসিয়ে দেয় আমারও; রুমা চিরুনি হাতে আয়নার দিকে ঘুরে দাঁড়ালে—চার ধারের ড্যাম্প দেওয়ালের ভিতর থেকে যেন চামচিকে বেরিয়ে আসে একরাস অথবা তারা সব রুমার নাইটির ভিতর থেকেই যেন বেরিয়ে আসে—পিছন থেকে ঘাড়ের কাছের নাইটির আধুনিক লেসের ফাঁস খুলে দিলে; সে সব আমার দুই হাত করে—যদিও তারপর চামচিকের গন্ধে মনে হয় যেন বহু প্রাচীন অন্ধকার এক ফসিল শরীর রুমার ! সেই ফসিল শরীরে দেবেশ কৃত ক্ষুধার্ত ক্ষত রুমার অসহায় চোখ যেন আমায় আঙুল দিয়ে দেখায় অথচ এই সব দেখার দুপুর থেকে আমি অনবরত পালাতেই থাকি কিন্তু পা আটকে থাকে কোথাও ! ক্ষমতার এ এক রাজনৈতিক আঠা !
দেবেশ বোকা নয়, কিন্তু তার সমস্ত মন ও মানসিকতা এক প্রাচীন বৃদ্ধ উটের মতো গমন অনীহায় স্থবীর—শুধু নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকার বাসনায় সে মাঝে মাঝে কোথাও উধাও হয়ে যায় অথবা এই পলায়ন বৃত্তি কখনোবা রোম্যান্টিক—অযাচিত কোন মরুদ্যানে ক্ষুদ্র জলউৎসে কিছু গুল্ম যেমন আকৃষ্ট হয়ে ক্ষনিক উল্লাসে বাতাসে পত্রবিলাস করে—সেই তাৎক্ষনিক আহ্লাদ মগ্ন দেবেশ দীঘার সস্তা হোটেলে হৃদয়বিহীন এক তাপজর্জর আদিমতায় রুমাকে আহৃত করে রাখে যে রুমা কখনো মনোল্লাসে কখনো শরীর মগ্ন তবু হৃদয়ের কোনো গভীর জলাজমিতে সে দেবেশের পদচিহ্ন অবলোকনে আনমনা এক স্বপ্নে বিভোর হয় কখনো, যে স্বপ্ন এক রাজকন্যার, তার অন্তরীন থেকে মুক্তি হবে একদিন ; কিন্তু দেবেশ রাজপুরুষ হতে পারে না, যদিও এসব ক্রীড়া ভঙ্গিমার অভিনয়ে রুমা তা বোঝে অথচ স্বপ্ন তাকে ঘুনপোকার মতো কুরে কুরে খায় ।
কলেজ ইলকেসানের মনোনয়ন পত্র জমা দেবার দিন চলে যায় , দেবেশ ফেরেনা , তার দীঘার সমুদ্র বড় বেশী গভীর;তাই বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় জেতার যে সম্ভবনা ছিল আমার তা হঠাৎ বিনষ্ট হল অবনী মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ায় ।
অবনীকে সেই প্রথম দেখলুম যদিও কলেজে সে ছিল তবু এর পূর্বে কখনো তাকে দৃষ্টি গোচর করবার অভলিাষ অনুভব করিনি ।
অমার জয় ব্যাপারটা ছিল সময়ের অপেক্ষা । ফল প্রকাশের পর দেখাগেল হাওয়া ঘুরছে ; যে নিরঙ্কুশতায় জেতার কথা ছিল তা হল না, কিছু ক্ষত রেখে গেল আমাদের চারপাশে । অবনী কাঁটার মতো গেঁথে রইল আমার ভিতর ।
সেই প্রথমাবধি অবনীর ছায়া যেন আমাকে অনুসরন করে শেষে অতিক্রম করে যেত চায় যেমন এক ব্রীড়াবনত
পরগাছা লতা মহিরূহ আকর্ষন করত পাকে পাকে নিজকে বেষ্ঠিত করে সূর্যালোকের দিকে এগিয়ে যায় ; অবনীও তেমনি দুশ্চিন্তার ছায়া রূপে সুকৌশলে আমাকে আবৃত করে থাকে অথবা এ আমার নিজেরি স্বকল্পিত মনপীড়া যা শুধুই ভাবিত করে যে হাওয়া ঘুরছে জদিও সেসব সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সুঠাম রেখায়িত হয়ে স্থূল বক্তব্য রাখে যে ক্ষমতাশীলদের কাছ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে—অথচ সেসব দূরের আদর্শগত সৌখিনতা—আমাকে উত্তেজিত করার কারন কখনোই নয় কেননা আমি নিতান্তই স্থানীয় ক্মমতা সন্ধানী এবং যার ভতির কোন আদর্শের মাড়িপীড়া নাই , এ নিতান্তই এক ক্ষুদ্র স্বার্থ গৃধ্নু নিকষ তরঙ্গ যা আদপে রুজি রোজগার বই কিছু না—তবু ক্ষমতা ভোগের অভ্যাস ক্রমাগত বুনন বসত উত্তেজিত হতে থাকে ।
এ উত্তেজনার কালে তিস্তা এল কলেজে । নতুন বেনো জলের মতো একরাস ছেলে মেয়ে নতুন সেসানে যেমন আসে প্রতি বছর ; তিস্তাও এল তাদের ব্যাচেই ।
তার তাম্রবর্ন অঙ্গের অপরূপ সৌস্ঠব সুষমা নিভৃতে পদচারনা করে শেষে ধুপের সুবাসে রমণীয় রেখার দেহধারনে যেন ব্যস্ত হয়ে আছে—যদিও এশ্যাম মুখমন্ডলে তার শাদা আসি সর্বদা প্রজাপতি হয়ে ওড়বার মানসে স্ফূরিত হয় যেন সূর্যও তার আজ্ঞাবহে নিজের ঔজ্জ্বল্য প্রকাশের আগে দুই মুহূর্ত ভেবে নেয় তথাপি আমার এ চিত্রার্পিত ভাব অশোভন তবুও হঠাৎ মনে হয় কোথাও বৃষ্টি হয়েছে বেশ—এখনো অনাবিল গন্ধ আছে ফুলেরও ।
তিস্তা কেমন আছো ?”—এই সামান্য একটি বাক্য যেন আমার মুখ নিসৃত লালা অসাবধানে—সহসা লজ্জিত, বুকের ভিতর বিন্দু বিন্দু ঘাম—“ এ কেন ? “ ;আমি নিজের দিকে তাকিয়েই চমকিত—এ বঙ্কিম সঙ্কোচ , যেনবা তালভঙ্গে হঠাৎ বিমূঢ় শিল্পী, আমার দৃষ্টিগোচরে তিস্তার দুই বক্র ভ্রুর বিলাস সুলভ কটাক্ষ আমার উল্লম্ব রেখায়িত শরীরে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে গিয়ে কিছু অন্বেষন—তার শোভিত কামিজের অন্তরালে দুই পক্ষিশাবক বুক মৃদু—অথচ অস্থির নিশ্বাসে কম্পিত, যে কম্পন তার তীখ্ন নাক অবধি এসে কুঞ্চিত ঘৃনায় আবিষ্ট; তার হাত অস্থির দ্রুততায় বুকের কাছে উঠে এসে ওড়নার ভাঁজ পুনরনির্মান করে ফের নিস্তেজ—অথচ তার মুখ—অধর তক্তিতার বিষাদ সঞ্জাত ক্ষনিক—
রজনীববু........! “
তার স্বরক্ষেপ কিছু খাদের দিক থেকে সূচিত হয়ে উত্তোরন পর এক বিস্ময় পূর্নচ্ছেদে গিয়ে শেয হয় ।
তিস্তার আরো কিছু কথার তরঙ্গ অপেক্ষায় থেকে—মৌন ক্ষনিক, সহসা অবনী আসে করিডোরে—তার সরসা চেহারা উন্নত নাসা,উদ্ধত গমন ভঙ্গি—এক হীনমন্যতা যেন গাছের ডালপালার মতো আমার সামনে আন্দোলিত হতে থাকে, তার নিহিত নঞার্থক আবেশ—ক্রমশ যা কুঞ্চন সৃষ্টি আমার মানসিকতার ভিতরে তথাপি এ সবই অন্তসলীলা,অবনীর কাছে নিশ্চিত বিলুপ্ত ।
সে তার সুশ্রী অবয়বে যেন এক ব্যঙ্গের স্তর পরস্পর সজ্জিত করে বলে—“রজনী তোমাকে আজকল দেখিনা কলেজে.....! “ কথাগুলি যেন আরো দীর্ঘক্ষন প্রলম্বিত করে আরো কোনো কথার সঙ্গে যুক্ত হবার মানসে হঠাৎ তা সমাপ্ত, যদিও কথাগুলি নিতান্ত উদ্দেশ্যহীন, অবনী যার কোন উত্তরের প্রত্যাশা করে না ।
সে তিস্তার দিকে ফের যা প্রত্যাশিত ভাবে খুব সুস্থির এবং স্বাভাবিকও বা ; তখনি তার হাসি ঠোঁটের চারপাশে ক্রমাগত ছড়িয়ে যেত গিয়ে অনাবিল—
তিস্তা তুমিও আসছ তো ? এসো.......”
ওরা দুজনে করিডোর পেরিয়ে গেল দ্রুত পায়ে । আমি ওদের যাওয়া দেখলুম । বুঝতে পারছিলাম ওরা কোথায় যাবে—ওদের পার্টির মিটিং আছে । বুঝলুম তিস্তাকে ও ।
এ বোঝা ঠিক রাজনৈতিক নয়—বহুদিন পরে অরাজনৈতিক কোন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু দেখলুল—দেখলুম মাঠরে পর মাঠ কীট আক্রান্ত ধানের ক্ষেত যেমন একদা—এখন শুধু খড়—হিম অস্থির হাওয়ায় ক্রমাগত আন্দোলিত—অথবা হাওয়া মুখ লুকায় উটপাখির মতো খড়ের ক্ষেতে—দৌড়ায় এ মাঠ সে মাঠ—অবিরত খস খসে—যেন হাওয়া ঘুরছে—তার অভিমুখ বদলে যাচ্ছে; একি ঐতিহাসিকতা ? এ কি মরা ফসলের ক্ষেত আবার ? আর তখনি প্রথম আবিস্কার করি এক শাদা দেওয়াল—আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমায় দেখছে; আমার সামনে সামনে হাঁটছে ।
তিস্তা যেন সেই দেওয়াল পেরিয়ে ধানক্ষেতরে দিকে আসে পাখির মতো অঢ়েল হাওয়ায়, তারপর দীগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় যেমন জলের তরঙ্গ—পুকুরে মৃদু কম্পন তার ক্ষনিক তথাপি কচ্চিৎ হাতে প্রলোভন নিয়ে ডাকি যদি—তবে হাসি তার অন্ধকারে তরঙ্গতুলে এক বক্র একাকিত্ব বুনন করত খিল্ খিল্—উধাও দূরে এক ঝাপসা ক্রন্দসী—সেথা বিন্দু বিন্দু ঘাম সিক্ত কামার দিবা রাত্রি—অথচ গোচরে তার কপোল লগ্ন অপরূপ তিল—মাঝরাতে ক্ষুধার মতো অন্তহীন বিষাদ—সেখানে বালি ঘড়ি ঝুর্ ঝুর্ করে অবনী হাসে—তার দুই কষ বেয়ে গড়িয়ে নামে অনর্গল হাসি ।
তর হাসি ধূর্ত মারীচ তুল্য ক্রমাগত উত্তেজিত করে তা হোম-অগ্নি—প্রলুব্ধ করে প্রতিষোধস্পৃহা যা আরো একবার রুমার মৃত্যু—ক্রুড় মনে হয়—“ক্ষতি কি ?”
দীঘা ফেরত সেবেশ কে আর দেখিনি আমি—অথবা দেখেছি তা স্মরনঅতীত ; সে কলেজ ছেড়ে দেয়—শহরে যায়—কারখানায় কাজ করে ; রুমার মুখে কিছু শুনে থাকতে পারি,যদিও তারা সব প্রয়োজনহীন—প্রসঙ্গহীন এখন, তবু খবর আসে কিছু ঘিন্ ঘিনে মাছির মতো—উড়ে বেড়ায়—এখন চরাচর জুড়ে অজস্র মাছি খবর যারা নিতান্তই বাহুল্য সৌখিন সময়ে ।
অথচ রুমার মৃত্যু ক্ষনিক ক্লেশ , অন্ত:সত্ত্বা কালীন তার গুলোট কান্না—দেবেশ ফেলে পলায়িত—আরো নিদারুন অভাব আর্থিক কিছুবা ,আমি স্বেচ্ছায় রুমার বাড়ীর পথ ভুল গেলে—অধিক ত্বরান্বিত ; অন্তিমে শুধুই এক পলিথিন আবৃত লাশ—ভ্যানট্রলিতে পড়ে থাকে সারাদিন থানার রোয়াকে ।
অথচ কতো সহজ তা—কদাচ কারো মনে হতে পারে জ্যাক রিপার ধরা পড়েনি কোনদিল—তার মৃত্যু হয়না—তার উত্তরাধিকার এক দেশ থেকে আরো এক দেশে ছড়িয়ে পড়ে;ওই সব চিল—ওই সব শকুন—এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশ অতীক্রম করে যায় অবহেলায় !
তিস্তার সব খবর আমি পাই—অবনী তখন গৌন—বুঝি রাজনৈতিক পরাজয় কখনো শাশ্বত নয়; হাওয়া ঘোরে—আবার ঘুরে আসে—ফিরে আসে তা ;কিন্তু তিস্তা ? বরং এক ঢ়িলে দুই পাখি !
ওদের পুরো ব্যাচ পুরুলিয়ায় যায় কলজে ট্যুরে । আমি আর কয়েক জন খবর নিয়ে ওদের কাছা কাছি এক লজে উঠি । সব কাজগুলো বড় অবহেলায় করছি আমি যেন এক অভিনয়—বড় অনায়াস কোন বিবেকের তরঙ্গ নেই অন্ধকারে—শুধু চলতে ফিরতে এক শাদা দেওয়াল—ঠিক চুনকাম করা ।
খবর পেয়েছি সন্ধ্যাবেলা তিস্তা আসবে—কাঁসাইয়ের চরে—অবনী আসবে ।
অভিনয় এর পর খুব সহজ—যা ঘটবে তার সব দায় তখন অবণীর ।
সন্ধ্যায় নদীর চরে ভিজে ভিজে বাতাস ওড়ে—চাঁদের আলো ঈষৎ জলের উপর যেন বিন্দু বিন্দু স্বদে , বাতাসের ঘায়ে তাদের ক্ষনিক প্রমত্ততা যেন নিষাদময়ী ধূসর প্রহেলিকা অদৃশ্য পিম্জরে অবদ্ধ—অনবরত তার ডানার ব্যাজন—ঈষৎ হিম আবেশ ক্ষনিক চমকিত—চমকিত তিস্তা—সর্ব্বগঠনে অপরূপা , চুল উড়ে মুখ ঢাকে ক্ষনেকে—পরিপাটি বস্ত্র বাতাসে শিথিল এলোমেলো , তার দুই হাত এয়ো-স্তীর পারিপাট্যে দেহ ঢাকে বার বার , মুখমন্দলে ভ্রুকুটি—অনবী আসে না,সে তখন আমার এক বন্ধুর সাথে আধো মদ্যপ, আলোচনায় ব্যস্ত অথচ তার মধ্যে উৎসুক ত্বরা-তিস্তার মিস্ কল আসে—তিস্তা ভয়ঙ্কর চমকায়—“তিস্তা কেমন আছো ?”—আমার স্বর প্রাগৈতিহাসিক গাঢ় ফিস্ ফিস্ !
কি চাও ?”—তিস্তার ঠোঁট চিৎকারের ভঙ্গি করে থামতে বাধ্য—আমার হাত তার মুখ চেপে ধরলে পর তার সমস্ত শরীর রমনীসুলভ ভীষন অস্থির—তুমুল বক্ষদ্বয়—অপ্রকৃতিস্থ—কম্পিত,শ্বাস রুদ্ধ—হাত ছাড়িয়ে ফিস ফিস—“আমাকে চাও?”...”আমাকে চাও?’’ স্বরক্ষেপে পীড়িত আর্তি ; সে পলায়িত চপল নয়, থলকে দাঁড়ায় ; ভীষন দ্রুত তার হাতের সঞ্চালন—চাঁদের আলোয় তার এক এক বস্ত্র খসে পড়ে—কবরী মোচন করত তার হি হি হাসি—প্রলাপ—উন্মুক্ত পীনস্তন দ্বয়—নিষ্ঠুর বক্র ব্যঙ্গ—“আমাকে চাও?”—বাতাসে ধাক্কা খেয়ে প্রতিদ্ধনীত—তথাপি আমি পিরামিড স্থবীর—আমার দুই পা যেন ক্রমশ বালিতে প্রোথিত—আমি খাদের ভিতর নিমজ্জিত—চারিদিকে বালি ধ্বস—শাদা দেওয়াল যেন আমায় ঘিরে ধরতে থাকে—অপরিমেয় গহন এক খাদে আমি—আমার শাদা দেওয়ালে সবুজ শ্যাওলা—আঁশ গন্ধ—মুখ আর্তির মতো ভঙ্গুর—চাঁদের আলোয়—তিস্তা দৌড়ায় , তার প্রতিনীর মতো খোলা চুল—প্রলাপ-হি হি হাসি—“তুমি হিটলার হতে পারো না......পারবে না “—হি হি হাসি ,তার পা যেন মাটিতে পড়ে না—দূরে সে ভেসে যায় যেন ভিজে বাতাসে অথচ আমি মুঠিটে বাতাস ধরতে গেলে শুধু মুঠো মুঠো বালি উঠে আসে হাতে !



POKHIRAJ

নয়ন এক মনে মাঞ্জার কাঁচ গুড়ো করছিল, হামানদিস্তা দিয়ে। হামানদিস্তাটা সে বড় কষ্ট করে জোগাড় করেছে—মা দেখতে পেলে আর রক্ষে থাকবেনা, তাই সে রান্না ঘর থেকে ওটি হাতিয়ে নিয়ে চুপি চুপি সোজা বাগানে পালিয়ে এসেছে।
কাচ ভাঁঙা গুলো জোগাড় করেছে পেমু। দুটো ফিউজ হয়ে যাওয়া বাল্ব, আর একটি ভাঙা টিউব লাইট। সে এক মনে নয়নের গুঁড়ো করা কাঁচ গুলো মিহি কাপড়ের চালুনি দিয়ে চেলে রাখছিল।
নয়নের বয়স সবে দশ—ক্লাস ফাইভে পড়ে। পড়াশুনায় সে মন্দ নয় তেমন ।শক্ত শক্ত অঙ্ক গুলো সে ভালোই করতে পারে। কিন্তু তার মুন্সিয়ানা অন্যখানে—ঘুড়ি বানানোয়। ঘুড়িই তার একমাত্র নেশা—ঘুমে জাগরনে সারাদিন সে ঘুড়িতে মগ্ন হয়ে থাকে। স্কুলে টিফিনের জন্য মা যে কয়টি টাকা দেয় তাকে, তা থেকে বাঁচিয়ে সে রঙিন কাগজ কেনে। সেই কাগজ দিয়ে, মাথা খাটিয়ে সে নানা রকম ঘুড়ি বানায়। কেনা ঘুড়ি তার পছন্দ নয়। এই ঘুড়ি বানানো নিয়ে সে বাড়িতে কম মারধোর খায়না! এই তো গত ইউনিট টেস্টের সময়ই, বাবা তার সবকটি ঘুড়ি ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। মায় কাগজ কাটার ছুরি কাঁচি পর্যন্ত আটকে রেখেছিলেন পরীক্ষা শেষ না হওয়া অবধি।
তবে এসব কিছু তাকে দমিয়ে রাখতে পারে না! পরীক্ষা শেষ হতেই সে নতুন উদ্যমে ঘুড়ি নিয়ে লেগে পড়েছে। কারন সামনেই বিশ্বকর্মা পুজো। তদের পাড়ার ক্লাব জাগরনী সংঘে প্রতি বছর বিশ্বর্কমা পুজোর পরদিন ঘুড়ি ওড়াবার প্রতিযোগিতা হয়। যার ঘুড়ি সবথেকে বেশী অন্যের ঘুড়ি কাটতে পারবে সেই হবে বিজয়ী। এতদিন সে ছোট ছিল বলে এতে নাম দিতে পারেনি। খেলার সময় মুখ মচকে তাকে বসে থাকতে হয়েছে বড় মাঠের ধারে। এবার সে ক্লাবের দাদাদের অনেক ধরে করে রাজি করিয়েছে। কিন্তু একটা ভয় থেকেই যায়। ছোটকা আবার ওই ক্লাবের সেক্রেটারি, শেষ মূহুর্তে বেঁকে বসলেই চিত্তির। তাই সে ছোটকাকাকে খুব একটা চটাচ্ছেনা! যা পড়া দিচ্ছে চট্ পট্ তা তৈরী করে ছোটকার মন যুগিয়ে রেখেছে।
তা সত্বেও আর একটা চিন্তায় সে কিছুটা মুষড়ে আছে। তা মাঞ্জা নিয়ে। এতদিন ছোটদের সঙ্গে ঘুড়ি কাটা কাটিতে তার মাঞ্জা ভালোই উতরে গেছে। কিন্তু এবার বড়দের সঙ্গে সে কি পেরে উঠবে! এই ভাবনায় তার ঘুম হয়না ক’দিন ভালো করে।
গতকাল দুপুরে এসব ভাবতে ভাবতেই সে ঘুরে বেড়াচ্ছিল বাগানে! অবশ্য বাগান বলতে তেমন কিছু নয়, বাড়ির পিছন দিকের কয়েক কাঠা পতিত জমিতে কিছু ফল, ফুলের গাছ ও কিছু আপন মনের আগাছা গজিয়ে উঠে নয়নের জন্য খেলার আস্তানা বানিয়ে দিয়েছে। একটি বড় জবাফুলের গাছে কিছু ডাল ছেঁটে দিয়ে একটা বসার মতো জায়গা বানিয়েছে নয়ন। সেটা তার সিংহাসন। ‘মহাভারত মহাভারত’ খেলার সময় নয়ন রাজা হয়ে সেখানে বসে।
সেই সিংহাসনে বসে থাকতে থাকতেই সে ঘুড়িটা দেখতে পায়। জামরুল গাছের একেবারে মগডালে, আটকা পরে আছে। পেটকাঠি, হলদে, সবুজ রঙ। নয়ন ঘুড়িটা দেখে অবাক হয়। এখন ঘুড়ি ওড়ানোর সিজন নয় তেমন—অবশ্য নয়ন সারা বছরই ঘুড়ি ওড়ায়। কিন্তু ওটাতো অন্য কারো ঘুড়ি। নয়ন অন্য কারো ঘুড়ি ওড়ায় না। সে প্রথমে ভাবল পেমুকে ডেকে ঘুড়িটা দিয়ে দেবে। তারপর কি ভেবে সে নিজেই গাছে উঠে পড়ে। একেবারে একটা সরু ডালের পাতায় আটকে ছিল ঘুড়িটা! সরু ডাল বেয়ে ঘুড়িটা পেড়ে নিয়ে নামতে গিয়েই বিপত্তি। সরু ডাল ভেঙে একেবারে মাটিতে পপাত চ। কিন্তু পড়ে গিয়ে তার মাথাটা একেবারে ভন্ডুল হয়ে গেল। অবাক হয়ে সে দেখল কোথাও তার এতটুকু ও চোট লাগেনি, তার মনে হচ্ছিল যেন কেউ তার হাত ধরে তাকে শূন্যে চাগিয়ে মাটিতে নামিয়ে দিয়েছে। ঘুড়িটিও একে বারে অক্ষত, নতুনের মতো। সে ঘুড়িটাকে যত্ন করে তার শোবার ঘরের আলমারির পিছনে লুকিয়ে রাখল।
রাত্রিরে শুয়ে শুয়ে সে স্বপ্ন দেখছে—মাঠে মাঠে বিশাল হৈ চৈ—সারা মাঠে অনেক লোকজন,তাদের সবার হাতে হাতে লাটাই। সবাই লাটাইটাকে সাইকেলের হাতল ধরার মতো করে ধরে আছে—ভাসছে তারা ঘুড়ির সঙ্গে ঘুড়ির মতো, হাওয়ায় লাটাই ধরে। নয়নও তাদের সঙ্গে উড়ে বেড়াচ্ছে, হঠাৎ দমকা এক বাতাসে সে এক জামরুল গাছে আটকা পড়ে গিয়েছে। কোনক্রমে হাঁচড় পাঁচড় করে ডালপালা সরিয়ে মুক্ত হবে নয়ন, তখনই ঘুম ভেঙে যায় তার। ঘুম ভেঙে যেতেই নতুন মাঞ্জার আইডিয়াটা মাথায় আসে তার! প্রতিবছর ঘুড়ি ওড়ানো প্রতিযোগিতায় জেতে লাটুর দাদা, বিট্টুদা; তার ইয়া বড় লাটাই, বিশাল শক্ত মাঞ্জা । বিট্টুদা কে একদম সহ্য করতে পারে না নয়ন! গতবার পুজোর সময় অকারনেই সবার সামনে তার মাথায় চাঁটা মেরে অনেক অপমান করেছিল তাকে। এবার তার সুদে আসলে বদলা নেবে নয়ন। এই ভাবনাতেই ভোর রাতের পর আর ঘুম আসেনা তার।
সকাল থেকেই তাই সে লেগে পড়েছে মাঞ্জা বানাতে।সঙ্গী পেমু—একান্ত বশংবদ নয়নের। মাঞ্জা ছাড়াও আরো কয়েকটি ঘুড়ি বানাবে সে। প্রতিযোগিতার নিয়ম আছে পাঁচটির বেশী ঘুড়ি নেওয়া যাবে না। পাঁচটি শেষ হয়ে গেলে, তার দৌড় সেখানেই শেষ করতে হবে!
গাছ থেকে পাওয়া ঘুড়িটা সে ভেবেছিল নেবে না, কিন্তু—কি ভেবে কে জানে সে ঠিক করেছে ঐ ঘুড়িটা নেবে। ঘুড়িটাতে একটা সুন্দর লেজ লাগিয়ে নিয়েছে সে।
মাঞ্জার মশলা তৈরী হয়ে গেলে কদিন ধরে সে খুব বায়না করল, বাবার কাছে, মার কাছে—একটা ভালো বড়ো লাটাই কিনে দেবার জন্যে; কিন্তু এ ব্যাপারে কেউই তাকে বেশী পাত্তা দেয়না—পাছে নতুন লাটাই পেয়ে পড়াশুনা একেবারে চড়কের গাছে তুলে দেয় সে! আবার বেশী বায়না করতেও সাহস পায়না, ছোটকার কাছে কথাটা গেলে, সব প্ল্যান বানচাল হয়ে যায়—এই ভয়ে।
টিফিনের পয়সা যা জমেছিল তা দিয়ে বেশ অনেকটা সুতো হয়ে যায়! এবার সে সবথেকে দামী সুতোটা কিনেছে! তারপর এক রবিবার সারা দুপুর সে আর পেমু মাঞ্জা লাগালো সুতোয়। দেখতে দেখতে বিশ্বকর্মা পুজো এসে গেলো—আগের দিন উত্তেজনায় সারারাত ঘুম হলনা নয়নের। প্রথমে ছোটকা শুনে একটু বেঁকে বসেছিল কিন্তু নয়ন অনেক অনুনয় বিনয় করে রাজি করিয়েছে।
দুপুর দুপরই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। জাগরনী সংঘের মাঠে লোক থই থই।
প্রথমদিকে নয়ন ভালোই লড়ছিল, তার নতুন মাঞ্জা বেশ কাজে লাগছে, পট পট করে বেশ কয়েকটা ঘুড়ি কেটে দিল সে। কিন্তু বিট্টুদা ওদিকে অপরাজেয়। তার সামনে এবার পড়ল নয়নের ঘুড়ি। কিছু লড়াই করার আগেই পর পর দুটো ঘুড়ি ভো-কাট্টা হয়ে গেল নয়নের। আগে একটি গিয়েছিল। এই দুটো নিয়ে তিনটে হল। চার নম্বর ঘুড়িটা নিয়ে সে কিছুটা লড়াই দিল, কিন্তু পেরে উঠল না। ঘুড়ি ওড়ানোর টেকনোলজিতে বিট্টুদা একেবারে মাস্টার লোক। প্রথমে সুতো ছাড়তে ছাড়তে হঠাত্ দুম করে উপর দিয়ে গোঁত্তা খাইয়ে পেঁচিয়ে কেটে দিল নয়নের ঘুড়ি। নয়ন এবার মুষড়ে পড়ল। তার খুব রাগ হচ্ছিল—কান্না পাচ্ছিল! কোনক্রমে দাঁতে দাঁত চেপে কুড়িয়ে পাওয়া ঘুড়িটায় সে সুতো লাগায়। সুতো লাগিয়ে একটু ওড়াতেই তার হাতে যেন বিজলি খেলে গেল। ঘুড়ি যেন সে ওড়াচ্ছেনা—ঘুড়ি নিজেই উড়ছে। ফর ফর করে তার হলদে লেজ পাখির লেজের মতো দুলছে। নয়ন শুধু লাটাইয়ের হাতলটা আলতো করে ধরে আছে। ঘুড়ি পাখির মতো—চিলের মতো ছোঁ মেরে, গোঁত্তা মেরে উড়ে বেড়াচ্ছে সারা আকাশময়। কি যে হচ্ছে নয়ন কিছু বুঝতে পারছে না, তার মাথা একেবারে ভন্ডুল হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে নয়নের একটু ভয় ভয় করছিল পরে ভয়টা কেটে যেতেই তার মেজাজ হাওয়া ভরা বেলুনের মতো হয়ে যায়। সেও যেন ঘুড়ির সঙ্গে উড়ে বেড়াচ্ছে! বিট্টুদার ঘুড়ি কোনো পাত্তাই পায় না। পর পর তিনখানা বিট্টুদার ঘুড়ি কেটে দিল নয়ন! নয়ন তখনই মনে মনে ঘুড়িটার নাম দিয়ে দিয়েছে—‘পক্ষীরাজ’! বিট্টুদার চার নাম্বার ঘুড়িটার সাথে পক্ষীরাজ যেন দেয়ালা করছে! সে নিজের খেয়ালে বিট্টুদার সাথে মজা করে যাচ্ছে। নয়ন শুধু লাটাই ধরে আছে আর মনে মনে হেসে কুটি কুটি হয়ে উপচে পড়ছে।
সবাই নয়নকে খুব সাবাশি দিচ্ছে। বিট্টুদার গর্ব একেবারে মাটিতে ছড়িয়ে ছত্রখান—অহঙ্কারী বলে তার পরাজয়ে অনেকেই খুব খুশী হয়েছে। এদিকে আবার এক বিপত্তি। পক্ষীরাজ কিছুতেই নিচে নামতে চাইছে না। সারা আকাশ সে নিজের খেয়ালে উড়ে বেড়ায়। ওদিকে নয়নকে বিজয়ী ঘোষনা করা হয়ে গিয়েছে। প্রাইজ বিতরন শুরু হয় হয়। কিন্তু পক্ষীরাজের নামার কোন লক্ষন নেই। শেষে নয়ন অনেক ধমক ধামক দিতে তবে সে নামে।
রাত্রে নয়ন মাথার কাছে নিয়ে শুয়েছে পক্ষীরাজকে। বাড়িতে আজ কেউ ঘুড়ি নিয়ে নয়ন কে বকা ঝকা করছে না। বরং প্রাইজ বিতরনের সময় ছোটকাকে সে বেশ খুশী খুশী দেখেছে।
মাঝরাতে নয়নের ঘুম ভেঙে যায়। মনে হয় পাখির মতো ফড় ফড় করে কি উড়ে বেড়ায় ঘরে। সাহসে ভর করে দুচোখ খুলতে তার মনে হয় যেন চোখ ধাঁধিয়ে যাবে—সারা ঘর ময় রামধনুর মতো এতো আলো। আরে ঘর কোথায়! ছাদ কোথায়? সব খোলা মেলা আকাশ হয়ে গিয়েছে, সেই চারদিক খোলা আলোর সমুদ্রে পক্ষীরাজ উড়ে বেড়াচ্ছে, উড়তে উড়তে পাখির মতো অনেক দূরে চলে যায়। নয়ন কিছু বলতে যায় কিন্তু তার গলা বুজে আসে! অবাক হয়ে সে শুধু তাকিয়ে থাকে।
~সমাপ্ত~