Search This Blog

Sunday, May 11, 2014

একটি কবিতার জন্ম ও মৃত্যু
অবিন সেন

মাঝে মাঝে কবিতা আসে না! যেটা আসে সেটা কিছু শব্দের কলকাকলি। যেমন শুরু করা যাক একটা লাইন পুঁজিবাদকে আমি ঘৃণা করি । তার পর দীর্ঘ অপেক্ষা এবং আরো দীর্ঘ অপেক্ষা, তার পরেও কোন সম্যক লাইন মাথার মধ্যে মাড়ি বেদনার মতো চঞ্চল বেদনার উদ্রেক করে না তথাপি ওই একটি মাত্র লাইন হাতে নিয়েই আমাকে বসে থাকতে হয়। হয়ত একবার বাজারে ঘুরে আসি, টয়লেটে যাই কিন্তু মাথার ভিতর সেই একটি মাত্র লাইন খেলা করে। এবং বার বার দ্বিতীয় লাইনের জন্য ক্লান্তি অনুভব করে। এই ভাবে কবিতার সঙ্গে ক্রমাগত আমার প্রতারণা চলতে থাকে। কারণ আমার সমস্ত কবিতাই আত্মজৈবনিক...নিজের সঙ্গে প্রতারণা ভিন্ন আমার কোনো কবিতা জন্ম উপলব্ধি হয় না। এই ভাবে পরস্পর প্রতারণার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে দিন শেষ হয়ে রাত্রি আসে। ওগো আমার রাত্রিকালীন কবিতা! আমার কবিতা যেন রাত্রিবেলার কাছে দায় বদ্ধ। সমস্ত দিনের ক্ষয় যেন আমার কবিতার গায়ে রাত্রির মতো লেগে থাকে। বস্তুত ক্ষয় ও অবসাদ ধূপের ধোঁয়ার মতো সারা ঘরে ঘুরে ভেড়ায় মনে পড়ে আমার ঘরের জানালা থেকে বাতি-স্তম্ভ দেখা যায় না ....একাকী বাতি-স্তম্ভ মোড়ের মাথায় আলো বিতরণ করে, দু একটা কুকুর তাদের গায়ে হলদে আলো। পতঙ্গরা উড়ে বেড়ায়, তাদের গায়ে ফসলের গন্ধ লেগে আছে যেন, আমার চাষাবাদ মনে পড়ে। অর্থাৎ
পুঁজিবাদকে আমি ঘৃণা করি
আমার ঘরের জানালা থেকে বাতি-স্তম্ভ দেখা যায় না,
তবু তার হলুদ আলো আমি টের পাই..
টের পাইযেন বুকের উপর দিয়ে ট্রাক্টর চলে যায়,
যেন চাষাবাদের পারে মানুষ দু একটা গোলার্ধ চষে ফ্যালে
আমার নিজের ভিতরের অবসাদ মানুষের অবসাদ হয়ে আমার অন্ধকার দেওয়ালের গায়ে ছায়া বিছিয়ে রাখে। চোখের কাছে জেগে থাকে সেই সব মাঠ যেখান এখনো সাব-মার্সিবল পাম্প পৌঁছায়নি, ডিপ-টিউব ওয়েল পৌঁছায়নি, সেখানে একাকী মেঠো এক মানুষ ডোঙাতে জল সেচন করে চলে, অল্প সেই জল সরু নালা বেয়ে পৌঁছে যায় ধান ক্ষেতে, সে সবুজ ধান ক্ষেতে , না না সে জল মাঠে নয় সে জল সেই একাকী মানুষের এক জীবন থেকে আর এক জীবনে পৌঁছে যাচ্ছে, এক আকাঙ্ক্ষা থেকে আর এক আকাঙ্ক্ষার উচ্চাশায়..একদিন কি তার ফসল পোকায় কাটে ? পোকা ও দালাল, তারা চুরি করে ফসল...চুরি করে ফসলের ঘর..অবসাদে ধসে যায় বালি...!! সেই একাকী মানুষটির কাছে পুঁজিবাদ মানে কি ? যৌনতা..ফসল ? সে কি রোজ সোনালী ফসলের লোভ কাঁধে নিয়ে ঘুমাতে যায় ? নাকি কবিতার ভিতর যে আমি ঢুকে বসে থাকি সেই আমি ও অলীক তার কাঁধে হাত রাখি, হাত রাখি বাতি-স্তম্ভের অল্প হলুদ আলোর মতো?
পুঁজিবাদকে আমি ঘৃণা করি
আমার ঘরের জানালা থেকে বাতি-স্তম্ভ দেখা যায় না,
তবু তার হলুদ আলো আমি টের পাই..
টের পাইযেন বুকের উপর দিয়ে ট্রাক্টর চলে যায়,
যেন চাষাবাদের পারে মানুষ দু একটা গোলার্ধ চষে ফ্যালে
চষে ফেলা মানায় কি তার ?  
তার তো ফসলের ভার কাঁধে কিংবা মাথার ভিতর অবাধ্য যৌনতা ঘুম ?
তার ঘুম পায়
ফসলের দাম পড়ে এলেবেলা পড়ে আসার মতো, বাতি-স্তম্ভের আলো
তার চোখে পড়ে না
তার ঘুম পায়
পুঁজিবাদ+যৌনতা+ঘুম

আসলে যোগফল শূন্য !



Sunday, December 30, 2012

টুকি



টুকি
অবিন সেন

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মনে পড়ে
কোনও ভাসমান ঘোড়সওয়ার আমার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে
চিবিয়ে নিচ্ছে দু-এক মুঠো অন্ধকারের বিচালি
কিংবা ফুচকা ওয়ালার তেঁতুলজলের বিষাদ,
টুকরো আলোর ইনডিকেটর ও তুচ্ছ কিছু মুহূর্ত !


মৃতদেহ সৎকারের পরে ঘরে ফিরে এসে আমার আর সারারাত ঘুম আসে না । আসতে পারে না? সারা গায়ে যেন তাপ লেগে থাকে, তাপ ভীষণ তাপ । পারমিতা ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক্ষন । ঘুমের ভিতরেই সে বলল—“টুকি!” আমি চমকে উঠি। আমি আবার শুনতে পাচ্ছি পারমিতা খাটের নীচে থেকে ডাকছে—“টুকি!”
আমি অনবরত শুনতে পাচ্ছি টেলি ফোনের বিপ বিপ রিংটোনের মতো পারমিতা ডেকে চলেছে “টুকি” “টুকি”
বাইরে এখন অনেক রাত, তথাপি হেমন্তের শিশিরে ভিজে আসছে ছাতিমের সুবাস। অন্ধকারের ভিতর জানালা দিয়ে আবছা ছাতিম গাছটা দেখতে পাচ্ছি।
পারমিতা পাশ ফিরে শুল এবার। তার একটা হাত এসে পড়ল আমার গায়। আমার ডান হাতের কনুইয়ের উপর তার স্তন। যেন ছাতিমের মাদকতায় ভণ্ডুল হয়ে সেই প্রগাঢ় স্তন আমায় উষ্ণতা দিচ্ছে অথবা দেওয়ার এক অভিলাস অন্ধকারের ভিতর ঘোড়সওয়ার হয়ে আমার উপর বসেছে—দু পা মেলে, চার পা মেলে অদ্ভুত স্বৈরিণী। কিন্তু “টুকি”!
বিয়ের পর প্রথমবার দীঘা গিয়ে এমনটাই হয়ে ছিল। সারা ঘরে লুকোচুরির মতো শুধু পারমিতা হরিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গমের সময় তার ভিতরে আমার পৌরুষের পাশবিক ভঙ্গি অথচ আমার সমস্ত সত্তা জুড়ে কেবলই মনে হয় শূন্যের ভিতর রতিক্রিয়ার ব্যকুল শৈত্য। যেন পারমিতার আড়াল থেকে পারমিতার ছায়া বেরিয়ে এসে আমার সঙ্গে রতিক্রিয়া করে ।
আমার ভীষণ ইচ্ছা করছিল পারমিতার “টুকি” ডাকে একবার সাড়া দিই বা দেওয়ার ভঙ্গি আমার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে চেপে ধরে আর কাঁপতে থাকে তির্ তির্ করে ঝাউ পাতার মতো । যেন নদীর দিক থেকে বয়ে আসছে বাতাস । তার হিম ।
আমি আরো গাঢ় হয়ে পারমিতার উষ্ণতার দিকে সরে যাই । গায়ে চাদর টেনে নিই । কিন্তু তখনো শুনতে পেলাম পারমিতা ডাকল—“টুকি”!
এ কি আমার স্বপ্ন। নাকি স্বপ্ন ভেঙে যাবার পরের নিদারুণ বিমূর্ততা ? সেটুকু ভালো করে বোঝবার জন্যে আমি পারমিতার দিকে আবার আড় চোখে তাকই। আর তাকাতেই কেমন যেনে ভেড়া হয়ে যাই । দেখতে পাই পারমিতা অন্ধকারের দেওয়ালের ভিতর এক অচেনা দরজা খুলে ক্রমশ তার মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে । ওদিকে কি অভয়ারণ্য ?
আমি চিৎকার করে বলতে গেলুম পাতমিতা যেওনা । যেওনা ওদিকে।
ওদিকের কোনো টেলিফোন নাম্বার আমার জানা নেই। জানা নেই ওখানে কোনো মোবাইল সিগনাল কাজ করে কিনা !
পারমিতা খিল খিল করে হাসল ।
তার হাসির শব্দ মিলিয়ে গেলে শুনতে পেলাম—“টুকি” ।
আমি তাকিয়ে দেখছি, পারমিতা যে দেওয়ালের ভিতর প্রবেশ করল সেটা আসলে একটা বাড়ি । একটাই বাড়ি। গম্বুজের মতো । কোনো জানালা নেই। আস পাশে কোনো বাড়ি নেই । শুধু সেই একমাত্র বাড়ি । শাদা চুনকাম করা । চারপাশে গাছপালা, যেন সদ্য বৃষ্টি ভেজার পরে ঝিল্ মিল্ করছে । আমি যত সেই বাড়ির দিকে এগিয়ে যাই তত গাছপালা গুলো পরস্পর সরে গিয়ে আরো ঘন হয়ে দাঁড়ায় । যেন আমার পথ আটকে রাখতে চায় । আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাদের সেই গমন দেখি । আর দেখতে পাই গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বিলাস। হাসছে । আমি তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম ।
অথচ বিলাস মারা গেল গত ভোরবেলা । এমন একা একা যে মনে হয়েছিল ভোরবেলার সমস্ত হিম যেন আত্মীয়ের মতো তার ঘরে পা-ছড়িয়ে বসে থেকেছে । হয়ত একা একা মরাটা তার একটা বিলাসিতা ছিল । তাই কি ? হয়তবা । আমি জ্ঞানে বা অজ্ঞানে বলাসের কোনো আত্মীয়কে দেখিনি । আদৌ কেই কোথাও ছিল কি না কে জানে বা জানার ভঙ্গীকরে কোনোদিন তার কাঁধে হাত রাখিনি । বিলাস আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে এসে জুটেছিল বা আমরাই তাকে জুটিয়ে নিয়ে ছিলাম । আমি ও পারমীতা । গতরাতে যখন শিশিরের আঘাতে শিউলি ঝরছিল তখন সেই ঝরা শিউলির ভিতর—হিমের ভিতর বিলাস একা একা মরে গেল। খোলা জানালা দিয়ে কোনো ছাতিমের সুবাস কি তার মাথার কাছে এসে বসেছিল?
এই যে এখন যেমন আমার মাথার কাছে এক অলীক পারমিতা ক্রমাগত ডাকছে—“টুকি, টুকি, টুকি”।
শুনতে পাচ্ছি এবং বলা ভালো দেখতেও পাচ্ছি পারমিতা এখন বসন্তের ফাগুন বউটির মতো হয়ে আছে । লজ্জাশীল-ব্রীড়ানত । সদ্য কনসিভ করেছে সে । ডালা ডালে তার বসন্তী ফুলের মতো সোহাগ।
আচ্ছা, পারমিতা যে কনসিভ করেছে তা কি বিলাস জানত? কথাটা আমার হঠাৎ মনে হল । কেন?
দীর্ঘদিন আমাদের  ফসলের ভূমি ছিল অকর্ষিত। ফসলের । সবুজ সিমের আকাঙ্ক্ষা সন্তান সন্ততির হাত ধরে মাঠের আলপথ ধরে হেঁটে যাবে আর হেমন্তের বিকেলে কিংবা শিশিরের ঘেরা টোপে নাড়ার আগুনে একটু সোহাগ ভরে নেবে চাদরের কোঁচড়ে। পারমিতার সেই সব আকাঙ্খা ছিল। আমারও কি ছিল না ?
“সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমা খাবো”।
কিছুক্ষণ আমার তন্দ্রার মতো এসে গিয়েছিল। চটকা ভাঙতে দেখলাম রাস্তার পাশে সমস্ত দোকানের সাটার নামানো আর আমি সেই শাদা রাঙের বাড়িটা খুঁজে পাচ্ছিনা । ল্যাম্পপোস্টের কাছে বিলাসের সঙ্গে দেখা।
শালা, তখনো দাঁত ক্যালাচ্ছে ।
আমাকে দেখে বলল—কি খুঁজছিস ?
-একটা শাদা বাড়ি ।
-অভয়ারণ্য?
-না, একটা শাদা বাড়ি। তার সবকটা জানালায় জানালায় খড়খড়ি নামানো। দরজাগুলো বন্ধ।
-বেশ্যাখানা ?
-না !
- ?
-আমি কখনো বেশ্যাখানা দেখিনি।
-যা শালা !
-কোনও দেবালয়ও দেখিনি ।
-ধুর, বোকাচো......
আমি হাসলাম । বিলাসের মুখখানা ওলটানো ব্ল্যাক ডগের বোতলের মতো লাগছিল । ইচ্ছা হল শালার গাঁড়ে কোষে এক লাথি দি।
কিন্তু তখনি শুনতে পেলাম—“টুকি” । হাত বাড়াতে রক্ত মাংসের পারমিতা হাতে ঠেকল । আমার হাতের থেকে আরো দীর্ঘ  এক হাত বেরিয়ে এসে পারমিতার মাংসল নিতম্ব জড়িয়ে ধরতে চাইল। কি তীব্র উষ্ণ সে মাংস । আমি চাদর সরিয়ে উঠে এসে জানালার সমনে দাঁড়াই। বাইরে শিশির ঝরছে । ক্রমশ সেই শব্দ আমি যেন শুনতে পাই, শুনতে পাই পাতার থেকে ঝরে পড়ছে স্নানের পরে পারমিতার চুলের থেকে জল, শিশির। আমার খুব হস্ত-রতির ইচ্ছা জাগে । খুব । যেন কল খুলে দিয়ে জলপাড়ার শব্দের ক্লান্তি । আমার যৌনাঙ্গের উপর দিয়ে হেঁটে চলে যায় পারমিতার ছায়ার শরীর । হেঁটে গিয়ে সে খুলে দিচ্ছে চারপাশের সমস্ত বন্ধ দরজাগুলি।
বিলাস সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করে। বিলাস ?
আমার সন্ধেহ হয় ।

নিস্তব্ধতার ভিতর কয়েক যোজন পা মেলে দিয়েছে গাছগুলি
তারা কি এগিয়ে গিয়ে শিশির ছোঁবে ?


সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি নিপুণ হাতে এক দুর্গের দ্বার খুলে দিই । দেখি সকালের রোদে ভেসে যাওয়া বারান্দায় একটি শালিক এসে বসেছে। গ্রিলে । আমার মুখো মুখি সে একটি হিজল গাছের ঘন পাতার মতো বসে থাকল স্থির । আমার বড় অস্বস্তি হয় । এক শালিকে এই অস্বস্তি আমার চিরকালের । মনে হল আমার চোখের ভিতর দিয়ে সে তাকিয়ে আমার সমস্ত অশুভ নক্ষত্রগুলিকে দেখে নিচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।
আমার অস্বস্তি আরো বাড়ত হয়ত—পারমিতা এলো।
চায়ের কাপ রাখল নিচু টেবিলের উপর ।
আমি কি পারমিতাকে শাদা বাড়ির কথা জানতে চাইব ?
কিন্তু আমি দেখেতে পাচ্ছি পারমিতার চারিদিকে হিজল বন ছেয়ে আছে। ছায়া দিয়ে আছে। আমার খুব ইচ্ছা করছিল আমি সেই ছায়ার নীচে দাঁড়াই। পারমিতাকে ছুঁয়ে দাড়াই।
পারমিতার ছায়া আড়াল করে বিলাস দাঁড়িয়ে আছে।
পারমিতার ভিতরে বিলাসের সন্ততি ?
আমার অসহ্যে মাথার ভিতর কুয়াশা ভণ্ডুল হয়ে থাকে।
আমি শীতের শুকনো পাতার মতো..................................................
............................................................................................

ফ্রিজ থেকে আর একটা সিগনেচারের বোতল নিয়ে আসে পারমিতা।
বিলাস তখন হাসছিল।
হাতের তাস টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাসল। হা হা করে গলা ফাটিয়ে সে হাসল।
ধুর বাঁড়া....তার পর জিব কাটল। সরি পার...মিতা...
তার কথা জড়িয়ে আসছিল।
আমার সমনে সে কখনো পারমিতাকে নাম ধরে ডাকে না। সেদিন ডাকল। আমি ছায়ার মতো অন্ধকারের ভিতর ঢুকে যাচ্ছিলাম।
আমি উঠে যাচ্ছিলাম। পারমিতা আমার ঘড় ধরে বসিয়ে দিল । না না...সে কি পারমিতা? আর হাত কি অ্যাত হিম? এত কঠিন?
কিংবা উত্তরের কঠিন হাড় হিম হাওয়া আমার ঘাড় ধরে বসিয়ে রাখে । আমি অবহেলায় দেখতে পাচ্ছিলাম আমার অসাড় হাত একটার পর একটা সিগনেচারের পেগ তুলে নেয়। সেই পেগ ভর্তি অজস্র হাসির খেউর। ফ্যাক্টরির চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়ায় বিকেলে পথঘাট ঢেকে গিয়েছে। রিক্সায় আমি আর পারমিতা ফিরছিলাম। মাথার ভিতর ডাঃ বিষ্ণু র কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল ।
-না না মি বোস..আই অ্যাম সরি, আপনার মিসের সব টেস্ট রিপোর্ট ঠিকই আছে। কিন্তু আপনার.........
আই মিন আপনি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই মি: বোস....
আমার চোখের সামনে তখন বিকেলের পথঘাট...বৃষ্টির পরে ভেজা ভেজা বাতার । কোথাও কোনো ত্বরা নেই...কিছু বলার নেই। পারমিতার হিম হাত আমার হাতের ভিতর। তারও কিছু বলার নাই। আমাদের বর্ষাকাল শেষ হয়ে এলো। আমাদের ফসলের আকাঙ্ক্ষা গ্রীষ্মে নদী নালা শুকিয়ে এলে পর যেমন নিশ্চুপ তেম্নি শান্ত। পারমিতাও শান্ত। শুধু রতিক্রিয়ার সময় সে আমার ভিতর থেকে হারিয়ে যায়...আমি তাকে খুঁজে পাই না। খুঁজে পাই না মোটে । দেবদারু অরণ্যের ভিতর থেকে সে সাড়া দেয়....টুকি—টুকি—

আমি কখনো কোনো দেবালয় দেখিনি...
দেখিনি কোনো বেশ্যালয়.....



অফিস থেকে ফিরে দেখেছিলাম পারমিতা ঘরে নেই।
থাকার কথাও নয় ?
তখন ফসলের সময়। কর্ষণের সময়।
আমি চারিদিকে ট্রাক্টরের আওয়াজ শুনতে পারছিলাম ।

জানালার পিছনে এখন তীব্র ট্রাক্টরের শব্দ
অনবরত....

এখন কর্ষণের সময় । ফসলের সঙ্গে মানুষের উচ্চাশার নিবিড়তা
সমাচারের মতো সমস্ত শিরা উপশিরা বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে । এখানে কথাবলা মানা ।

চলো বাইরে গিয়ে দাঁড়াই । কথা বলি।
ঘরের বাইরে কি উচ্চকিত শব্দ নেই ?
বাইরে ?
ঘরের থেকে বাইরে ?
নিজের ছায়ার থেকে, ছায়ার বাইরে—
পেঁয়াজের মতো এমনি পরস্পর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে
জীবনের থেকে জীবনের পরম্পরায়....

দেখি
এক নদীতীরে দাঁড়িয়ে আছি
বাতাস নেই....ঢালু পাড় নেই....

কেবল স্রোতে ভেসে চলে যাচ্ছে অকারণ ছায়াগুলি”।


এই ভাবে ফসলের সময় পারমিতা সারা দুপুর বিলাসের কাছে থেকেছে । একদিন। দুইদিন....
তারপর...
পারমিতা ফিরে এলে তার চোখে মুখে দেখেছি নদীর সরসতা । বর্ষার শেষে যেমন খাল বিলের জল আহ্লাদে স্ফুরিত তেমনি উজ্জ্বল মেয়েটির মতো হয়ে গিয়েছে পারমিতা।
-পারমিতা...আমাদের সন্তান যদি বিলাসের চোখ-মুখ-নাক পায়?

পারমিতার ওষ্ঠ আমার মুখ বন্ধকরে দেয়। তার উষ্ণ শ্বাস বায়ু ভেঙে পড়ে আমার মুখে। সে হাঁপায় । তার পর ফোঁপায় । সমস্ত ঘর আমাদের হিজলের ছায়ার মতো ভারি হয়ে আসে। আমি সেই শাদা বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি । কিন্তু বিস্ময়ে দেখি পারমিতা সেই বাড়ির ভিতর হারিয়ে যাচ্ছে না । না না সে কোনো ভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে না । শুধু একটা জানালায় বিলাসের ম্লান মুখ । সেই বাড়ির দরজায় বাইরে থেকে তালা দিয়ে ফিরে আসছে পারমিতা। আর ফিরে এসে আমার হাত ধরেছে।


-লক্ষ্মীটি বিলাস এই ওষুধ টা খেয়ে নাও প্লিজ।
বিলাস ম্লান হাসে। নেশায়। শালা কি সব বুঝতে পারছে? বুঝতে পারছে এ ছাড়া তার কোনো গতি নেই, উপায় নেই! না হলে অমন ধূর্ত বেড়ালের মতো তাকিয়ে আছে কেন? আমি একটা একটা পেগ বানাই। পারমিতা একটা একটা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেয়।
তারপর অনেক রাতে আমরা অন্যমনস্কের মতো আমাদের ঘরে ফিরে আসি।
পরিপাটি হয়ে একা ঘরে ঘুমিয়ে থাকে বিলাস ।
বস্তুত পৃথিবীতে বিলাসের মতো একা কেউ নেই । জানালা দিয়ে আশ্চর্য এক গন্ধ সেই মাত্র আমি পাচ্ছিলাম । আমি ফিস ফিস করে বললাম—
বিলাস ছেলেবেলার কোনো গন্ধ পাচ্ছ ? পাচ্ছ না ? তাহলে গাড়ি কি রিক্সা বা কিছুর শব্দ ? কিংবা শব বহনের মতো গাঢ় ভার তোমার কাঁধে ? তাও না ।
-প্লিজ বিলাস...একবার বলো—“আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”।
প্লীজ বিলাস---

১০

চায়ের কাপ তুলে নিতে এসে পারমিতা হই হই করে বলল—
এই এই বাজারে যাও.....ঘরে রান্নার মতো কিছু নেই......শেষের দিকে অভিনয়ের মতো তার কি গলা ধরে এলো...??
আমি চেয়ার থেকে উঠতে গেলে সেই শাদা বাড়ির জানালা থেকে বিলাস ডাকল—
টুকি—টুকি—

                                                ----০----





Tuesday, May 8, 2012



চিলেকোঠার কবি

          ঝমঝমিয়ে দারুণ এক বৃষ্টি এলো দুপুর বেলা—আমার চিলেকোঠার ঘরে। বৃষ্টি তার রূপের দেমাক ভারি, তার চিকন কালো ছায়া আমার ঘরের আয়নায় লগ্ন হয়ে রইল যেন কালো পশমের মতো মোলায়েম এক ইয়ার্কি করতে থাকল, যে আয়নার সঙ্গে আমার চিরকালের আড়ি ! আমার প্রথম ব্রণ ওঠা আমি তার চোখেই প্রথম দেখি—সেই থেকে আয়নার  সঙ্গে আমার মুখ দেখা দেখি নেই। সেই আয়নায় এখন শুধু সারাদিনের আলোছায়ারা খেলা করে, এমনি সব সহজ ঠাট্টা আমার রোজনামচায় নির্লিপ্ত হয়ে আছে।
          এই আয়নায় মুখ দেখে তরু! তরু আমাদের একতলার ঘরের ভাড়াটে।
          আয়নায় আবার আমি আকাশটাকে দেখি।
          “আকাশ-মুখো মেঘের সারি,
          দিচ্ছে পাড়ি
          আয় দুপুর
          নিঝুম নিয়ে নৌকা গড়ি....”
লাইনগুলো এ বাছর প্রথম যেদিন বৃষ্টি হল সেদিন লিখেছিলুম। তারপর কতকগুলো সমান্তরাল রেখা টেনে টেনে সেগুলো কেটেছি—আবার লিখেছি—আবার কেটেছি, মাথাটা কেমন ভণ্ডুল হয়ে গেছিল তারপর—মাথার ভিতর যেন শুধু সমান্তরাল রেখা। তখন আমার চারপাশের পৃথিবী—বস্তু—মানুষ সবাইকে সমান্তরাল রেখার মতো মনে হয়, কেউ যেন কারো সঙ্গে টাচ করে নেই, টাচকরে থাকার কোনো অভিপ্রায় নেই—সার্থকতা নেই, সঙ্কল্প নেই পৃথিবীতে, যেমন আমার চিলেকোঠার ঘরে শালিক খড়কুটো ছড়াচ্ছে, মাঠের ভিতর থেকে ফসলের ভিতর থেকে খাবার খুঁটে এনে বাসায় রাখছে, বৃষ্টির পরে রোদ বিলি কেটে যাচ্ছে জানালার কাছে.....তেমনিই সবকিছু। তেমনি যেন সব।
          এমন আমার হয় মাঝে মাঝে—এমন ঘোর...এমন প্রাণের ভিতর এক নির্লিপ্ত প্রলাপ—এক নির্লিপ্ত নিঃসাড় বোধ কাজ করে—কেউ জানে না কেন এমন প্রাণের ভিতর হেমন্তের মাঠের মতো কুয়াশা—শূন্যতার ঘোর খেলা করে। মেঝে মাঝে। আজো কি তেমনই হবার ছিল।তেমনি?
          দুটো চড়ুই কিচির মিচির করে আমায় বাঁচিয়ে দিল। দেখলুম দুটো পাখি জানালার কাছে এসে আমার অনেক বয়স বাড়িয়ে.. দেখলুম আঠারো বিশ বছরের ছেলে কেমন নিমফুলের গন্ধের মতো প্রবীণ হয়ে গিয়েছে। অথচ নিমফুলের গন্ধে কতই না ব্যথা, ব্যথা দিয়েছে প্রাণে সেই সব অলীক ফুল, সার্থকতা—ভণ্ডুল হবার জন্যে ব্যর্থতায় সমস্ত সরলরেখা গুলো যেন একে অপরের ঘাড়ে পড়ে যাচ্ছে হুড়মুড় করে। আর তার পর আমার সমনের পৃথিবীকে নানা রঙের ছাপ ছাপ মোজাইকের টালির মতো হয়ে যেতে দেখি।
          তরু কখন এসেছে বৈদেহীর মতো হঠাৎ খেয়াল করলুম। মা বলে তরু বাতাসের মতো আসে যায়, এমনি মৃদু..নিঃশব্দ যা শারীরিক দৈন্যে প্রকট, হাঁটা চলা তাই শব্দহীন যেন তার। শব্দ বা হল্লার দিকে নির্লিপ্ত। অসুখে ভুগে ভুগে শরীরের সমস্ত পুষ্টি যেন স্থগিত হয়ে গিয়েছে। যেমন অন্ধকার প্রাচীরের আড়ালে ঘাসেরা হলুদ নিস্তেজ হয়ে যায়, তেমনি এক অসুখের অন্ধকার এক দেওয়াল তরুকে ঢেকে দিয়েছে, অথবা সেই অন্ধকার দেওয়ালের নীচে তরু যেন চাপা পড়ে গিয়েছে।
          সে চুলে শ্যাম্পু করেছে। তার সেই হালকা সুবাস নাকে লাগল। ছেলেবেলায় যেমন বাবলার সুবাস পেতাম, তেমনি সহজ...তেমনি সহজ তার মুখ, তেমনি নিষ্পাপ। তেমন যেন কোথাও দেখনি। তার দিকে তাকালে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। এমনি ভোরের মতো নরম সেই মুখ।
          তরু কোনও কথা বলেনা। চুপি চুপি এসে জালাটা খুলে দেয়। এতক্ষণ ঘরের ভিতর যে বাতাসটা বন্ধী হয়ে ছিল, সে যেন হঠাৎ মুক্তি পেল। আর সেই শূন্যতার ভিতর কিছু ঠাণ্ডা বাতাস এসে যেন আমোদ শুরু করে।
          তরুর নাইটিতে ফুল ফুল বিষণ্ণতা। তার আজো জ্বর এসেছে। তার কপালে হাত রেখে আমি সেই উত্তাপ টের পাই।
          পাখিদুটো তখনো ঝগড়া করে চলেছে।
--দ্যাখ, পখিদুটো সমানে জ্বালাচ্ছে।
--জ্বালাক না!
তরু আড়া হয়ে শুল হাতে ভর দিয়ে।
পাখিদুটোকে দেখছিল।আমরা সবাই কি একদিন বাধাহীন হতে পারব? যেমন বৃষ্টির পরে এক হলুদ রঙের আলোর প্রীতি জন্ম নেয়, সোঁদা গন্ধের মতো..তখন পৃথিবী কি কার্ত্তিকের মাঠের মতো হয়ে যায়! ফুলগুলো—গাছগুলো? স্কুলের মাঠের পাশে হাসনুহানা ফুটতে দেখেছি একদিন, দেখেছি তার ঢের আঘ্রাণ শালিকের ডানায় বিকেলের আলো হয়ে যেতে। দেখেছি স্কুলের জানালাগুলো কুয়াশায় অপরিচিত ক্যানভাস হয়ে থাকে—সেই সব ক্যানভাস ছুটির মতো সহজ—পাতায় সকালের রোদের মতো সহজ—আমরাও একদিন সহজ হয়ে যাব?
          তরুও কিছু ভাবছিল। সে কি ভাবছিল আমায় বলছিল না। আমার সামনে বসে কেউ কিছু ভাবলে আমার খুব অস্বস্তি হয়।
--এই তরু কি ভাবছিস?
তরু আমার কথায় কেয়ার করে না, স্বগতোক্তির মতো করে বলে-
‘রবিঠাকুরের একটা গান জানিস—“তবু মনে রেখো/যদি যাই চলে দূরে.....” জানিস?’
--জানি। প্রেম পর্যায়ের গান। কিন্তু এ গান কেন? এই বৃষ্টি বাদলায়?
--এমনিই! আজ যেন সবকিছু দূরে চলে যাচ্ছে, সবকিছু!
তরু হঠাৎ কেঁপে উঠল।
তরুর হাত আমার হাতের ভিতর বাসনায় বিলীন হয়ে গেলে পর আমি অস্ফুটে ডাকি
--এই তরু, তরু...
তরু আমার বুকের কাছে সরে আসে। তার মাথাটা যেন আমার বুকের কাছে মিশে যায়, শালিকের বুক ঘাসের অন্তরের ভিতর মহার্ঘ হয়ে ওঠে। তার সমস্ত শরীরটা আমার দুই হাতের ভিতর নারকেল পাতার মতো তির তির কর কাঁপতে থাকল। তার সমস্ত শরীরের ভিতর থেকে অসুখের ভাপ—মাথার চুল থেকে শ্যাম্পুর গন্ধ উঠে এসে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। আমি সেই বাবলা ফুলের গন্ধ টের পাচ্ছিলাম আবার। অসুখের পরিপূরক হয়ে উঠে সেই গন্ধ যেন পৃথিবীকে বলল—“থাক!”। আমার পৃথিবী, আমার প্রহর যেন থমকে রইল। থমকে রইল চারপাশ—চরাচর—একটা থমকে থাকা হলুদ রঙের বিকেলের দিকে যেন পিঠ করে দাঁড়িয়ে রইল পৃথিবী।
তরু কখন নীচে নেমে গেছে বুঝতেই পারিনি। আমার বুকের ভিতরটা তখন এক জাহাজঘাটের ব্যর্থ নাবিকের মতো হয়ে গেল। সেই সব ইংরেজ আমলের পুরানো আর মাস্তুল ওলা স্টিমার ছেড়ে যাচ্ছে বিকেলের গঙ্গায়। বিকেল নয়, হয়তবা তখন সন্ধ্যা—গঙ্গার পারের গাছগুলোকে কালো কালির আঁচড়ের মতো ইজেলে লগ্ন বলে মনে হচ্ছে। সেই সব গাছ এদেশের না...এদেশের হেমন্তের না...সে কোথাকার চিলির কিংবা আর্জেন্টিনার রুক্ষ মাটির গাছ, সেই রকম কোথায় এক ভাঙা ইটের বাড়ি বা সমুদ্রের ধারের বাতিঘর..তার পুরানো বাথরুম, অন্ধকার—লোনাধরা—জানালার ভাঙা কাচে ভৌতিক শব্দ, নানা রকম, সেখানে বাসে আমার প্রথম কৈশোর কবিতা লিখেছে। নখের আঁচড়ে পুরানো দেওয়ালের চুন খসে পড়েছে। সে না কার্তিকের না হেমন্তের তা কবেকার এক দ্বন্দ্ব নীচতলার ঘরের অন্ধকার...ড্যাম্প, অসুখ। কলতলার পুরানো শ্যাওলা..সবুজ এবং মনোহারী! তরু সেই অন্ধকারের ভিতর চাপা পড়ে গিয়েছে, হুড় মুড় করে সে অন্ধকার অসুখের দেওয়ালে..পুরানো ইটের দেওয়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে। সেই অন্ধকারের মুক্তি কি হাসপাতাল? সবাই হাসপাতালে যায়, আমি যাই না। আমার হাসপাতালে খুব ভয়...সেই সব শাদা চুনকাম করা দেওয়ালের হাসপাতাল,পুরানো পুরানো সব ইট, পাথর...গন্ধ..মনে হয় আদপেই কোনও সংকল্প নেই হাসপাতালের।
          রাত্রে কাকিমা ছাদে এসেছিলেন। অশরীরীর মতো পায়চারি করছিলেন অন্ধকারে। কাকিমার সমস্যা সাতকাহন। তরুকে নিয়ে—কাকুকে নিয়ে। কাকুর মতো ব্যক্তিত্বহীন মানুষ আমি দেখনি। চোখের উপরতিয়ে সংসারটা ভেসে যায় তবু তিনি বসে থাকেন উদাসীনের মতো তাঁর নিজের গান সুর তাল নিয়ে। সখের গানের মাস্টারি করে কি দিন চলে?
          কাকিমা বোধহয় কাঁদছিলেন। পৌর্ণমাসীর চাঁদ কাকিমার গালে চিকচিক করছিল জলের ধারায়। আমার চিলেকোঠার ঘরে বসে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। গুঁড়ো গুড়ো অন্ধকার আমার মনের ভিতর ঢেউ ভাঙছিল। ঢেউয়ের ভিতর তরু—গাছের মতো আবছা নীরব ছায়া ফেলে ভাসছে। আমি সেই ভাসানের ভিতর কবিতা লিখছিলুম, কাচের জানালায় কালো কালির স্কেচ পেন দিয়ে—
“পড়ে আছে পাতার শূন্যে নীরবতা
জলাভূমি শিয়রে স্মারকের মতো—
ধানক্ষেত অনাবিল হাওয়ায় শুয়ে আছে
পৌর্ণমাসী মাটি ও মনের গভীরে
গাছের জন্মের মতো
আছো?
তুমিও? ভিতরে আমার—
উঠোনে মুথা-ঘাস বেড়ে জঙ্গলা দিনে
ঘোর বর্ষায় দামি কিছু চিকুরের জল
দু-হাত ছুঁয়ে গেছে তাই!
গেছে তাই? ভেসে নাভিমূল থেকে হৃদয়ও—
মধ্যরাত্রে অব্যর্থ উৎসব—
শিউলির ঘ্রাণে দগ্ধ মনস্তাপ ।“

লেখা শেষ করেই জালাটা খুলে দিয়েছি। চাঁদের আলোয় সারারাত ভিজবে কবিতা...ভিজে ভজে যেন হয়ে যাবে কবিতার উৎসব, সমুদ্রের পারের হাওয়ার মতো মাতাল হয়ে থাকবে সরারাত। সরারাত ধরে সে ভিজবে অঘ্রানের কুয়াশায় আর শিশিরে। ভিজে ভিজে একসময় ভোররাতে আবছা হয়ে যাবে অনেক লেখা..আবছা হয়ে যাবে শিশিরে স্বপ্নের মতো ঘ্রাণ ও কবিতা।
          ঘর থেকে ছাদে নেমে এলে কাকিমা চমকায় আমার পায়ের শব্দে। দ্রুত হাতে চোখের জলকে গোপন করে নেয়।
--তুই কখন এলি?
--আমিতো ছাদেই ছিলাম!
--খেয়াল করিনি।
--কাকিমা তরু কেমন আছে?
কাকিমা চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ—তারপর স্বগতোক্তির মতো করে বললেন-
--মাথার আঘাত, কি রক্ত—কি রক্ত—তবে ছেড়ে দেবে কাল, হাসপাতাল থেকে..
আমার মনে হল জ্যোৎস্নাটা যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। অনেকটা আলো—হাসির মতো—খুসর মতো খুরে বেড়াতে থাকল সারা ছাদময়। যেন আলোর ফুলগুলি সব অন্ধকার কুড়িয়ে নিয়ে কোঁচড়ে ভরে রেখেছে। সেই আলোর ফুলের মধ্যে একটা বেমানান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন
--তরুটা বোধহয় বাঁচবে না! দিনদিন কেমন হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।
কাকিমা নীচে নেমে গেলে মনে হল জ্যোৎস্নার ভিতর কোথাও যেন অন্ধকারের ভাপ জমে আছে। সেটা যেন আমার চারপাশে ছড়িয়ে যেতে থাকল এবার।
          সেই ভাপের ভিতর মনে হচ্ছিল যেন ঘর বাড়িগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে—ঘুড়ির মতো চারপাশ জুড়ে, খড়কুটো উড়ে বেড়াচ্ছে। আমিও তাদের সঙ্গে তাল রেখে উড়ে বেড়াই। লাটাই নিয়ে এসে সারারাত আমি ঘুড়ি ওড়াই। জ্যোৎস্নার ভিতর। অঘ্রানের কুয়াশার ভিতর। ছাদের আলসের উপরদিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল এবার যদি টাল খেয়ে পড়ে যাই?
--শালা সারা আকাশটা হাসবে তখন । নক্ষত্ররা দাঁতবার করে এ ওর ঘাড়ে পড়তে থাকবে হুমড়ি খেয়েছ তার পর লাট্টুর মতো পাক খেতে খেতে মলিয়ে যাবে এক বিশাল শূন্যের ভিতর—স্বপ্নের ভিতর।
          এই সব সাত পাঁচ ঘুড়ি ও লাটাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে ভোরের দিকে আমার খুব ক্লান্তি এল। ঘুম এল চোখ উপচে। ঘুমুতে ঘুমুতে স্বপ্নে দেখলুম অ্যাকোয়ারিয়ামের ভিতর ভাসতে ভাসতে মা ও বাবা আমায় লক্ষ করছে। আর তখনি ঘুম ভেঙে মনে পড়ে গেল আজ তরু আসবে।
          তিনদিন পরে তরু এলো আমার চিলেকোঠার ঘরে। হেমন্তের মাঠে এক হলুদ রঙের বিকেল এলো...ঝাউ-বনের থেকে বাসার এলো চরুয়ের আহ্লাদ যা অপেক্ষের মতো । সেই অপেক্ষার সারি বেয়ে একরাশ পতঙ্গ উড়ে এলো—ভরে দিল ঘর-। দুপুরের দিকে দারুণ এক বৃষ্টি এলো। বৃষ্টি মতই তরু আসে...সমু্দ্রের ঘরে যে বাতি ঘরে যে নাবিক ছিল তার কাছে। বসে সে তার চিরাচরিত আলগোছ ভঙ্গিমায়...চোখ তার ফসফরাস। বুকের ভিতর হিম জমে আমার..হিম কুয়াশা, হেমন্তের প্রান্তরের মতো কিংবা কাচের মতো ভেঙে ভেঙে রক্তাক্ত করে আমার বিবেক। সেজো কাকিমার মেয়ে প্রগাঢ় প্রাগৈতিহাসিক গলায় বলেছিল একবার—“এত কাঁপছিস কেন?”আমার গলার খালি করে সমস্ত শ্বাস টেনে নিতে নিতে বলেছিল সে। তখনো আমার বিবেক কাচের মতো ভাঙে, রক্ত ছোটে ফিনকি দিয়ে সারা গা বেয়ে। এখনো মনে পড়ে সেই ভাঙা দেওয়াল..সেই নির্জন ভাঙা দেওয়াল। আমি গহন পুরুষের মতো দেখি তরুকে। আঘ্রাণ করি তার সারা শরীরের সুবাস। আমার অসাড় জিব বলে—“তরু তোকে দেখব!” তরু চমকায়। ঘরবাড়ি চমকায়। কাড়ত করে বাজ পড়ে। বৃষ্টি আসে আরও ঘন হয়ে। কাচের জানালায় সেই বৃষ্টির জল নামে। তরু তখন নারী—বৃষ্টির মতো নিবিড় চোখ তুলে চায়—তার কদম কিশোরী বুক সহজ স্রোতের মতো অতল ঢেউ ভাঙে আমার বুকের ভিতর।আমার বুকের থেকে একটা একটা কাচের টুকরো ঝরে পড়ে। ক্ষত সারে। তরু হাসে—তরু কাঁদে—

          পাগলি তরু হাসে—পাগলি তরু কাঁদে—জ্বরের ঘোরে তরু কাঁদে—তরু হাসে—তরু হাসে--এমনি নিষ্ঠুর সে হাসি—এমনি নিষ্ঠুর এক স্টিমার ঘাট...সন্ধ্যার ইজেলে সারি সারি ঝাউ গাছের ভিতর থেকে একটুখানি আলো দেখা যায়—সে ঘাট থেকে স্টিমার ছেড়ে গেলে সে আর ফেরে না..ফেরার কোনো সংকল্প থাকে না? শুধু কি কিছু কল্পনা—কবিতা—বাতিঘর আর অনাবিল হাওয়া..হেমন্তের কুয়াশায় নিবিড় হয়ে নির্লিপ্ত হয়ে থাকে....সেখানে কোনো আশা নেই...সংকল্প নেই...শুধু অবসাদ ও কুয়াশা...সেই কুয়াশার ভিতর তরু সন্ধ্যাতারা হয়ে আছে।

……………………………………………………………………………..o…………………………………………………………19/07/08

Monday, June 13, 2011

ভোর

ভোর
অবিন সেন

কোনদিন ঘুমভেঙে দেখি জ্যোৎস্নার স্তব
কোনদিন ভোরবেলা,
গাছেরও ডানা আছে—তাও
শকুনের অবিশ্বাস
বৃহন্নলা কোন নদীর তীরে
ছায়া পালটে পালটে চিতা জ্বেলে দেয়—
অনিমেষ উষ্ণতায়,
গাছেরাও উড়ে উড়ে দিকহারা
শকুনের মতো—
জ্যোৎস্নাটিকে মৃত জেনে নিয়ে রাতের
জানালা খুলে দেয়—দেখি ধু ধু কোথাও
লালগড়, কোথাও নেতাইগ্রাম, যেন
অবিশ্বাস কোলে করে বসে—
ভোরের প্রথম পাখিটিকে শকুনের মতো দ্যাখে !

প্রসঙ্গ কবিতা

প্রসঙ্গ কবিতা
অবিন সেন
কবিতা কেন লিখি এ একটা জটিল ব্যাপার, আসলে এটা এখন ঘুম থেকে ওঠা বাহ্যে যাবার মতো--না করে পারি না, এর মধ্য কতটা শিল্প থাকে জানি না, অন্তত ঘুম থেকে ওঠার মধ্যে কি আর ক্রিয়েটিভিটি আছে ? সে তো এমনিই করে ফেলি, আসলে সেই একটি কথা, না করে পারি না! হ্যাঁ তার মধ্যে অনেক সময় অনেক ব্যথা থাকে, বেদনা থাকে....কষ্টের ফল বলেই কি শিল্প? ছেলেবেলায় আমি নাকি তিনদিন ছাড়া পটি করতুম সে এক বড় কষ্টের ছিল ! তার মধ্যেও কিছু শিল্প থাকা উচিত ? অন্তত কেউ সেটা সিনেমায় দেখালে সেটা শিল্প হয়ে যেত নিশ্চয়ই। তা হলে দেখা বা দেখাবার মাধ্যমটা হয়ে গেল শিল্প, তেমন কথার পর কথা সাজিয়ে যে কবিতা প্রাণ পেল সেটা শিল্প নয় , বরং তার ভঙ্গিটা শিল্প,আজের কথাই ধরা যাক অফিসে বসে মনে হল
to fly in the sky
to fly in the sky
২৭ বছর ধরে এমনি একটা বিষাধ
যাযাবরের মতো
কিংবা বেড়া....এটা কোন শিল্প হচ্ছে না, এটা নিজের সঙ্গে নিজের বাক্যালাপ, যেমন নদীর ধারে এক একা বেড়াই , অনায়াসে, কবিতাও বা কবিতা নয়।
তারপর অনেক্ষন আড্ডা দিয়ে, আবার মনে পড়ল
আগুনের মতো মোরগ ফুল-
দুপুরে জানালার বাইরে
বেড়ার ধারে.......................এবার মনে হচ্ছে এটা কবিটা , খাতা নিয়ে বসতে...সেই কোষ্ঠকাঠিন্য ব্যথা, পরের লাইনটা আর মনে আসে না, তার পর বউয়ের সঙ্গে ফোনে গল্প করে এসে মনে পড়ল..
জানালার বাইরে হাত বাড়ালেই
রোদের মতো আঙুলে লেগে যায়
ছিন্নমূল আবেগ....সে শাদা স্কুল বাড়ি
সে পুকুরে শ্যাওলা,..............এ গুলো এমনিই আসে, এ এমনিই অনুভবে আসে, এতে শিল্প আছে কি না জানি না...শুধু মনে পড়ে সুখে দুখে এ সব এমনিই আসে....এতে ভূগোল আছে, ইতিহাস আছে..বিজ্ঞান আছে...আছে তবে ,তাদের মতো করে আছে ।

আমাদের রোজনামচা, আমাদের খাওয়া , ঘুম, সংস্কৃতি সবারই শিল্পের কাছে টিকি বাঁধা আছে; আমরা এই যে রোজ রোজ একটু একটু করে খরচ হয়ে যাচ্ছি তাও শিল্প বইকি...তাহলে যে লোকটা পুকুরে জাল ফেলছে, জাল ফেলতে ফেলতে মাছের জন্য অপেক্ষা করছে আর যে লোকটা টেবিলে বসে ভাবছে " পটললালের মনে হয় তার মাথার ভিতর এক ব্যাঙ বাস করে" তারা শিল্পের নিরিখে পাশা পাশী কাছা কাছি হয়ে যায় যদিও আমরা শিল্পের সভায় সেই দ্বিতীয় জনকেই ডাকব কারণ সে সাহিত্যিক সে পৃথিবীর রঙ তুলি দিয়ে নিজের মতো করে শিল্পের উপর আরও কিছু সৃষ্টি করছে....তাই এ দু জন মানুষ কাছাকাছি হয়েও বোধহয় কাছাকাছি নয়..এক নৌকার মাঝিকে "আমার সোনার বাংলা " গাইতে দেখে সদ্য প্রয়াতা সুচিত্রা মিত্র কেঁদে ফেলে ছিলেন...বলে ছিলেন একবার যে তিনি নিজে কেন এতো আকুল হয়ে এ গান গাইতে পারেন না..এখানেও সেই অনায়াস রঙ রূপের বাইরে আরো সৃষ্টির খেলা আছে...সে শুধু জীবন যাপন নয়..আবার সে কিছু দেবার বা নেবার জন্যেও নয়, দেবার জন্যেই যদি হয় তবে তা নিজের কাছে...এখানে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়েকটি লাইন তুলে দিই "আমাদের সৃষ্টি করবার ভার যে স্বয়ং তিনি দিয়েছেন। তিনি যে নিজে সুন্দর হয়ে জগৎকে সুন্দর করে সাজিয়েছেন, এ নিয়ে তো মানুষ খুশি হয়ে চুপ করে থাকতে পারল না। সে বললে, ‘আমি ঐ সৃষ্টিতে আরও কিছু সৃষ্টি করব।’ শিল্পী কি করে। সে কেন শিল্প রচনা করে। বিধাতা বলেছেন, ‘আমি এই-যে উৎসবের লণ্ঠন সব আকাশে ঝুলিয়ে দিয়েছি, তুমি কি আলপনা আঁকবে না। আমার রোশনচৌকি তো বাজছেই, তোমার তম্বুরা, কি একতারাই নাহয়, তুমি বাজাবে না?’ সে বললে, ‘হাঁ বাজাব বৈকি।’ গায়কের গানে আর বিশ্বের প্রাণে যেমন মিলল
অমনি ঠিক গানটি হল। আমি গান সৃষ্টি করব বলে সেই গান তিনি শোনবার জন্যে আপনি এসেছেন। তিনি খুশি হয়েছেন; মানুষের মধ্যে তিনি যে আনন্দ দিয়েছেন, প্রেম দিয়েছেন, তা যে মিলল তাঁর সব আনন্দের সঙ্গে– এই দেখে তিনি খুশি। শিল্পী আমাদের মানুষের সভায় কি তার শিল্প দেখাতে এসেছে। সে যে তাঁরই সভায় তার শিল্প দেখাচ্ছে, তার গান শোনাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘বাঃ, এ যে দেখছি আমার সুর শিখেছে, তাতে আবার আধো আধো বাণী জুড়ে দিয়েছে– সেই বাণীর আধখানা ফোটে আধখানা ফোটে না।’ তাঁর সুরে সেই আধফোটা সুর মিলিয়েছি শুনে তিনি বললেন, ‘খুশি হয়েছি।’ এই-যে তার মুখের খুশি– না দেখতে পেলে সে শিল্পী নয়, সে কবি নয়, সে গায়ক নয়।যে মানুষের সভায় দাঁড়িয়ে মানুষ কবে জয়মাল্য দেবে এই অপেক্ষায় বসে আছে সে কিছুই নয়। কিন্তু, শিল্পী কেবলমাত্র রেখার সৌন্দর্য নিল, কবি সুর নিল, রস নিল। এরা কেউই সব নিতে পারল না। সব নিতে পারা যায় একমাত্র সমস্ত জীবন দিয়ে। তাঁরই জিনিস তাঁর সঙ্গে মিলে নিতে হবে। "
তাই বোধহয় পটললাল আর রবিবাবু এক হয়েও এক নন । কিন্তু পটললালের কথা যে ভাবছে সে তার রঙ তুলি নিয়ে পটললালকে নিজের মতো করে সাজাচ্ছে, সে সেটা অনায়াসেই তা করছে, সে ভাবছেনা সেটা আদৌ শিল্প হচ্ছে কি হচ্ছে না ! সে শুধু নিজের কাজটা করে যাচ্ছে....কারণ না করেও সে পারছে না...এই নিজেকে নিবেদন করা নিজের কাছে, এটাই তার নিয়তি।

হাতের লেখা খারাপ ছিল বলে বাবা-মা আমাকে ছবি আঁকার স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন, সেই আমার ছবির সাথে অন্য পরিচয়..গাছ, পাখি, ফুল আঁকতে আঁকতে একদিন দেখলুম গাছ ফুল পাখি দেখার ভঙ্গিটা কেমন বদলে গিয়েছে, আগে যে ছিল শুধু গাছ, পরে সে যেন গাছের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য কিছু , এ শুধু ছবির খাতা নিয়ে চিত্র চর্চা নয়, যে ছবিটা আঁকব বলে আঁকা হল না সে ছবিকে মনের মধ্যে নিয়ে খেলতে বসলুম....যে শুধু ছিল তালগাছ সে যেন হয়ে গেল
"তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে ।
মনে সাধ , কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
একেবারে উড়ে যায় ;
কোথা পাবে পাখা সে ?"
সেই আমার ছবির ভিতর দিয়ে কবিতার সঙ্গে পরিচয়। বলা যায় ছবিই একদিন আমায় হাত ধরে কবিতার কাছে নিয়ে এলো..আমি ছবি আঁকা ছেড়ে মনের ভিতর ছবি সাজাতে বসলুম...তারপর সেই ছবিই একদিন কথার রূপ পেল।তখন থেকেই ছবি লিখতে বসলুম, ছবি পড়তে বসলুম..আস্তে আস্তে আমার কবিতা পড়ার অভ্যাস তৈরি হল।যত দিন গেল কবিতার ছবিও পাল্টে পাল্টে যেতে লাগল...কখনো তা আমার চারপাশের ছবি যা আমার দৈনন্দিন জীবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে..যেমন ধরা যাক-"কুমোর-পাড়ার গোরুর গাড়ি —
বোঝাই-করা কলসি হাঁড়ি ।
গাড়ি চালায় বংশীবদন ,
সঙ্গে-যে যায় ভাগ্নে মদন ।
হাট বসেছে শুক্রবারে
বক্সী-গঞ্জে পদ্মাপারে ।
জিনিষপত্র জুটিয়ে এনে
গ্রামের মানুষ বেচে কেনে ।
উচ্ছে বেগুন পটল মূলো ,
বেতের বোনা ধামা কুলো ,
সর্ষে ছোলা ময়দা আটা ,
শীতের র‍্যাপার নক‍্‌শাকাটা ।"
এ ছবি চোখের সামনে চলচিত্তের মতো জেগে ওঠে। আর এক ধরনের ছবি আছে যাকে চারপাশে দেখি না, সে আমর চারপাশে নিবিড় হয়ে নেই...সে ছড়িয়ে আছে মনের ভিতর...মনের চশমা দিয়ে তাকে দেখতে হয়।"পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে চাওয়া নাটোরের বনলতা সেন"...পাখির নীড়ের মতো চোখ শুধু মনের ভিতরেই থাকে। সে জ্যোৎস্নার মতো আবছা আলো দেয়,সে নদীর মতো আলগোছে তীরটিকে মাখে,সে আমদের রোজকার নিয়মের বাইরে । সন্ধ্যার ভোঁ বাজলে আকুল মাঝির মতো বলে "পারে যাবে? পারে যাবে?"সেই অচেনা ছবির আত্মপ্রকাশই আসলে একরূপ কবিতা...আমার কবিতা ।

আমাদের পটললালের যখন অবসর থাকে তখন সে খবরের কাগজের ভালো ভালো পছন্দের খবরগুলি কেটে কেটে সাজিয়ে রাখে।নানা রঙ পেনসিল দিয়ে সেই খবরগুলিকে চিত্রিত করে, এ তার অবসরের বিলাস, ঠিক কবিতা লেখার মতো, নিজেকে ,নিজের মননকে নিজের মতো করে সাজানো! যেমন তেমন করে সাজানো নয়,সে সাজানোর মধ্যে মিশে থাকে আত্মিকতার সৌন্দর্য! কিন্তু পটললাল যখন অফিস যায়,তখন সব কিছুতেই তার ত্বরা, সে সময় তার খবরের সুন্দর তত্বের প্রয়োজন নেই, বাস্তব প্রয়োজনই সেখানে বড়, সেসব আত্মিকতার গুঞ্জনে পূর্ণ নয়, তার দেখার ভঙ্গি impersonal.
সভ্যতার সূচনায় যখন মানুষ তার খাওয়া, পরা, প্রভৃতি প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে উঠে ভাবতে শিখল,যখন তার অবসর সময় কে কোলে নিয়ে বসল, তখন সে ঈশ্বরের সৃষ্টির উপরেও নিজের মনের রঙ মেশাবার প্রয়োজন বোধ করল--তার কবিতার মাধ্যমে, গানের মাধ্যমে,চিত্রের মাধ্যমে! সে বাইরের বিশ্বকে বরন করে নিল বিশেষ রসের আতিথ্যে।"ফুল তার আপন রঙের গন্ধের বৈশিষ্ট্যদ্বারায় মৌমাছিকে নিমন্ত্রণ পাঠায়;সেই নিমন্ত্রণ লিপি মনোহর।কবির নিমন্ত্রণেও সেই মনোহারিতা ছিল।"সে মনোহারিতার শিল্পকর্ম ছিল মানুষের ব্যক্তিগত অভিরুচি ও চেতনার উপর।আসলে ভগবানের নানা সৃষ্টির ছলা কলায় যে মোহ খেলা করে সেই মোহকেই মানুষ মুখ্য বলে মনে করেছিল।তাই মানুষের তৈরি শিল্পে ছিল মোহের ছলা কলা, সে বাস্তবকে অস্বীকার করেনি কিন্তু তাকে গৌণ ভেবে তার উপর সজিয়ে ছিল ছন্দ সুর তালের আলো আঁধারি। কবিতাও ছিল তাই ছন্দের মালায় সাজানো।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন
" সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছন্দে বন্ধে ভাষায় ভঙ্গিতে মায়া বিস্তার ক’রে মোহ জন্মাবার চেষ্টা করেছি, এ কথা কবুল করতেই হবে। ইশারা-ইঙ্গিতে কিছু লুকোচুরি ছিল; লজ্জার যে-আবরণ সত্যের বিরুদ্ধ নয়, সত্যের আভরণ, সেটাকে ত্যাগ করতে পারি নি। তার ঈষৎ বাষ্পের ভিতর দিয়ে যে রঙিন আলো এসেছে সেই আলোতে উষা ও সন্ধ্যার একটি রূপ দেখেছি, নববধূর মতো তা সকরুণ। আধুনিক দুঃশাসন জনসভায় বিশ্বদ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে লেগেছে; ও দৃশ্যটা আমাদের অভ্যস্ত নয়। সেই অভ্যাস পীড়ার জন্যেই কি সংকোচ লাগে। এই সংকোচের মধ্যে কোনও সত্য কি নেই। সৃষ্টিতে যে-আবরণ প্রকাশ করে, আচ্ছন্ন করে না, তাকে ত্যাগ করলে সৌন্দর্যকে কি নিঃস্ব হতে হয় না।"
কিন্তু নদী যেমন চলার পথে গতি পাল্টায়, সাহিত্যেও তেমনি এক একটা বাঁক আসে। আসলে সময়ই তাকে পাল্টায়, বিজ্ঞান তাকে পাল্টায়। বিজ্ঞান এসে আস্তে আস্তে মানুষের থেকে তার অবসরের সময়টাকে কেড়ে নিল। এতদিন যে প্রকৃতিকে মনে হয়েছিল মায়া, বিজ্ঞান এসে বল্ল না- এ আসলে অণু ,পরমাণু, গণিত । এ বাস্তব । সে মানুষের অভিরুচি মেনে চলে না। তার কাছে ফুল যেমন বাস্তব, তার পাশে নর্দমার জলও বাস্তব । তার আকাঙ্ক্ষা সত্য অনুসন্ধানের--আমিকে বাদ দিয়ে বস্তুটা কি সেই কৌতূহলেই তার আনন্দ ।তাই সময়ের ব্যয় সঙ্কোচ যখন শুরু হল তখন সবার আগে বাদ দেওয়া হল প্রসাধনকে । একেই আধুনিকতার লেবেল এঁটে সাবেক কাব্য থেকে আলাদা করে রাখা হল ।"সাবেক-কালের যে-মাধুরী তার একটা নেশা আছে, কিন্তু এর আছে স্পর্ধা। এর মধ্যে ঝাপসা কিছুই নেই। "
তাই এবার ব্যক্তিকে সরিয়ে স্থান নিল বস্তু ।এজন্যই কাব্যে বাস্তবতাকেই আগে রাখা হল,অলঙ্কার হয়ে পড়ল বাহুল্য ।"কেননা, অলংকারটা ব্যক্তির নিজেরই রুচিকে প্রকাশ করে, খাঁটি বাস্তবতার জোর হচ্ছে বিষয়ের নিজের প্রকাশের জন্যে। "
আসলে আর্টের ধরনাটাই আস্তে আস্তে বদলে যেতে লাগল, এখন তার লক্ষ মনোহারিতা নয় মনোজয়িতা ।সে মোহ কে ছেড়ে সমগ্রতার দিকে গেল , সে সাহিত্যের মাধ্যমে সৃষ্টির মাধ্যমে নগ্ন সত্য পৃথিবীটাকে প্রকাশ করে দিল । সে শুধু সময়ের সঙ্গে পা ফেলে চলবে, সেটা সুন্দর হল না অসুন্দর হল সেদিকে সে মুখ ফেরাবে না ।পটললালের খাটা পায়খানাও কাব্য, তার পাশের বাড়ির দোতলার বারান্দায় যে নীল শাড়ি শুকায় সেটিও কাব্য । পটলাল প্রতিদিন খবরের কাগজথেকে মৃতের সংখ্যাটা ডাইরিতে টুকে রাখে ।টুকতে টুকতে ভাবে তার মাথার ভিতর দিন রাত এক ব্যাঙ ডাকে ।মলয় চৌধুরীর জখম কবিতার দুটি লাইন দিয়ে এখন লেখা শেষ করছি
"বুকের বাঁদিকের আর্মেচার পুড়ে গেছে বহুকাল
এখন চোখ জ্বালা করছে মলয়ের কঙ্কাল জ্বালানোর ধোঁয়ায়"
৫আমাদের পটললালের মঝে মাঝে মনে হয় কবিতা কেন পড়ি, বা কবিতা কেন পড়ব ?তবু পটললাল কবিতা পড়ে,এই জন্যে যে পাছে ভালো কিছু হাতছাড়া হয়ে যায়...তা না হলে কবিতা না পড়েই দিব্বি কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে, এই রকম মানুযের সংখ্যাই বরং বেশি— যারা গল্প উপন্যাস পড়েন, তথ্যাশ্রয়ী গদ্য রচনা পড়েন অথচ কবিতা না পড়েও বছরের পর বছর দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারেন। তবু কি তারা কখনো কবিতা পড়েন নি? পড়েছেন পটললালের মতোই—পাঠ্য বইয়ের কবিতা গুলি, বা রবিন্দ্র-নজরুলের আবৃত্তি যোগ্য কবিতাগুলি যেমন ‘আফ্রিকা’, ‘বলাকা’, বিদ্রোহী’র মতো কবিতা। বা আবৃত্তি শুনতেও ভালোবাসেন ‘আমিই সেই মেয়ে’ মতো কবিতার আবৃত্তি । কিন্তু এই আকস্মিকতার বাইরে শুধু কবিতার আগ্রহে কবিতা পাঠ করেছে এমন ঘটনা পটললালের জীবনে ঘটেছে বলে সে মনে করতে পারে না...তেমনি একান্ত নিরিবিলিতে শুধু কবিতা পাঠের জন্য কোন কবির কোন এক বই খুলে বসেছি এমন অভিজ্ঞতাই বা আমাদের কতজনের আছে ?আগে একটা সময় ছিল আমাদের পিতামহ-প্রপিতামহ দের আমলে, যখন আবসর সময়ে তারা রামায়ন, মহাভারত খুলে বসতেন বা কোন মঙ্গলকাব্যের মতো একম্তই পদ্যে লেখা কোন গ্রন্থ । সে সময় রসসাহিত্য বলতে যেটুকু ছিল সেটুকুই থাকত পদ্যের আশ্রয়স্থলে ।তারপর যুগ বদলেছে, বিজ্ঞান এসে আস্তে আস্তে প্রকৃতির রহস্যগুলি খুলে দিয়েছে...চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলেছে-দ্যাখো, তোমরা যে সব গুলিকে মায়া বলে জানতে সে গুলি আসলে পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা , গনিত ইত্যাদিবই কিছু নয় । মায়া বা ইলিউসালের জায়গা নিল বিজ্ঞান ও তার সত্যঅনুসন্ধানের কৌতুহল । জন্মনিল বাস্তক সত্যকে প্রকাশ করার ভাযা, ছলা-কলার অশ্রয় থেকে বেরিয়ে এসে আত্মপ্রকাশ করল গদ্য বা নতুন অঙ্গিকের কবিতা, যাকে আমরা আধুনিকতার লেবেল পরিয়ে দিলুম ।ক্রমর্বমান বিণিজ্যিক বিভীষিকা, নগরসভ্যতার নতুন ক্রিতদাস শ্রমিক, ধর্মে আস্থাহীনতা, চিন্তাজগতে নৈরাজ্য ও জগত জোড়া অনিশ্চয়তা আমদানি করল এক নতুন বাস্তবজীবনমুখিতা, বলিযষ্ঠতা ও সত্যভাষিতা যার আলোকে সাধারনের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। পদাবলী আশ্রিত নারীহৃদয়ের কবোষ্ঞ আবেগ, প্রেম প্রীতি নির্ভর গার্হস্থ্যজীবন-বন্দনাতে অভ্যস্ত হয়ে কবিকৃতি সম্পর্কে যে নিশ্চিত ধারনা তৈরী হয়ে গিয়েছিল তার মূলে কুঠারাঘাত পড়ল ।রোমান্টিক প্রকৃতি ধ্যানে এল সংসয়, সৃষ্টির মূলে হল দেহের প্রতিষ্ঠা । আকুন্ঠ আত্মবিশ্লেষনকে পাঠকের মনে হল ভন্ডামি, কপট আত্নগ্লানি । কবির সৃজনবাসলা আর পাঠকের রসপিপাসার ভরকেন্দ্রটা ক্রমশ নড়বড়ে হয়ে পড়ল ।
পাঠকের মনে হল-“ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/ পূর্নিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”।
পটলালের বউ যখন রাতকরে অফিসথেকে ফেরে তখন পটললালের মনে হয়-“জ্যোৎ স্না যেন ঘেয়ো কুকুরের মতো পরোকিয়া করে যায়”।
 পটললাল আমাকে একবার কালিদাশ ও শকুন নিয়ে তার একটা স্বপ্নের কথা বলেছিল—‘একদিন কালিদাশ দেখল তার গজদন্ত মিনারের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন এসে বসেছে, সে বুঝতে পারছেনা এত শকুন কোথাথেকে এল!সেই শকুনেরা একটা করে তার কা্ব্যের লাইন খাচ্ছে আর তখনি তারা একএকটি সুকুমার পাখি হয়ে যাচ্ছে । সে সব মাতাল পাখি । তারা সব মামুষদের কামড়াচ্ছে আর মানুষও পাখি হয়ে গিয়ে বইমেলা যাচ্ছে”।
 হিচকক কিন্তু তার সিনেমায় আর এটা দেখালেনণা ।
এই পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে কবি তা হলে কি করলেন?
সুধীন্দ্রনাথ দ্ত্ত বল্লেন-“জনসাধারনের রুচির প্রতিআমার অশ্রশ্রদ্ধা এত গভীর যে তাদের নিন্দাপ্রশংসায় আমি উদাসীন.....যারা কবিতাকে ছুটির সাথী বলে ভাবে,কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃদকম্মন অনুভব করতে চায় তাদের কবিতা না পড়াই উচিত”।
কবিরা বল্লেন কবিতা সাহিত্যের গতানুগতির রস দ্বারা পুষ্ট নয়। কবিতা বুঝতে হলে পাঠককে এগিয়ে আসতে হবে, আধুনিক কালের বিপর্যয় ও সঙ্কট টিকে বুঝতে হবে,মনসমীক্ষার বকযন্ত্রে আধুনিক কাব্যরীতির পাঠনিতে হবে। এ ঠিক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতরস আস্বাদনের মতো ।কবিতার সঙ্গাটাই যে পালটে গেছে সেটা বুঝতে হবে ।মনের সে অনুশীলন করতে হবে । পটললাল তো তা বোঝে না, সে বুঝল ইনিয়ে বিনিয়ে ছন্দ মিলিয়ে দিলেই বুঝি কবিতা হয়—ক্লাস সেভেনে উঠে পাশের বাড়ির ফুলটুসিকে চিঠিতে লিখল—“তুমি মম হৃদয়ে বীরাঙ্গনা/তুমি মম জীবনে বারাঙ্গনা”।
 তারপর যা হয় আরকি সে চিঠি পড়ল ফুলটুসির মা’র হাতে...অতয়েব প্রহারে কবিতার পলায়ন ।পটললাল তো আর বুঝলনা যে কবিতা আজ এখন আর স্বাভাবিকের সহজ অধিকার নয়, নগর সভ্যতা যেমন বৈদগ্ধ্যের বহির্লক্ষন, তেমনি কবিতাও—কবিতাও সেই একই বৈদ্গ্ধ্যের সচেতন শিল্পকৃতি ।আগে যে কারনে মানুয কবিতা লিখত সে কারনটাও গেল গুলিয়ে। কবি এলিয়ট বল্লেন—“The Poet must become more and more comprehensive, more allusive, more indirect, in order to force, to desolate if necessary, language into his meaning”
কবি নিজেকে নিজের কবিতা থেকে বার করে আনবার চাবিকাঠি বারকরে আনলেন, পাঠকে বল্লেন তোমরাও তোমাদের “নিঃসৃত সত্তাকেই পাবে আমার কবিতায়” ।
এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সাধারন পাঠক confusion এর মধ্যে পড়ে গেল, সে সরে গেলেন কবিতার কাছথেকে, কবিতাকে এক দুর্বোদ্ধতার লেবেল এঁটে দিয়ে ।

পটললাল তার ডাইরিতে একবার লিখলে “ভালোবেসে বইটিকে”...এ কোন বইয়ের নাম নয়, এ একটা সূচি, যে ভালো ভালো বইগুলি, অর্থাৎ যে বইগুলি তার ভালো লেগেছে সে গুলির একটি তালিকা সে তৈরি করে রেখেছে। সেখানে উপন্যাস আছে, গল্প আছে, প্রবন্ধবই আছে কিন্তু কোন সম্পূর্ন কাব্যের তালিকা সেখানে নেই। কিন্তু পটললাল তো মাঝে মধ্যে কবিতা পড়ে, কোন আসরে কবিতা আবৃত্তি হলে সে মন দিয়ে তা শোনে তবু সম্পূর্ন একটা কবিতার বই সে মনে করতে পারে না। তাহলে এই যে এতো কবিতা লেখা হচ্ছে, এতো আয়োজন কবিতা প্রকাশের, বইমেলাকে ঘিরে, পূজাসংখ্যা ঘিরে, সে ক্ষেত্রে এত কবিতা পড়েন কারা? বস্তুত কবিতার সাধারন পাঠক কারা?একটি অখন্ড সার্বভৌম কাব্য পাঠকের ধারনা করা নিছকই কল্পনা মাত্র। একটি বৃত্ত টেনে সে গোষ্ঠিকে আলাদা করাও যায় না ।আমাদের প্রাচীন আলঙ্কার সর্বস্ব কবিরা বলেগেছেন কাব্যরস হচ্ছে “সহৃদয়হৃদয়সংবাদী” ।
 একান্ত রসিক চিত্ত ব্যতিত কাব্যরস অনুধাবন করা অসম্ভব । অর্থাত কবি যে ভাবকে বা রসকে মূর্ত করতে চান তা যদি পাঠকের মনের অনুকূল না হয়, তবে সেই কাব্য সেই পাঠকের কাছে ব্যর্থ। “কবির কাজ পাঠকের চিত্তে রসের উদবোধন।...কাব্য কোন পাঠক বিশেষের মনে রসের উদ্রেক করবে কিনা তা কেবল কাব্যের উপর নির্ভর করে না, পাঠকের মনের উপরেও নির্ভর করে” --(অতুলচন্দ্র গুপ্ত)।
সুতরাং পাঠকে্রও একটা দায়িত্ব আছে কাব্যকে ‌আত্বীকরনের বিষয়ে। অর্থাৎ কবিতার ইমেজটিকে পাঠকের মনে ধরা দিতে হবে । তা যদি না হয় তবে সে প্রকৃত কাব্য পাঠক নয়। যেমন কবিতার প্রতি পটললালের প্রীতি আছে, প্রেম আছে কিন্তু সে কবিতার ইমেজটিকে মনের প্রজেকটারে ফুটিয়ে তুলতে পারে না।
এ ক্ষমতা অনেকেরই নেই, কবিতা আস্বাদনের ক্ষমতাও সকলে্র নেই কথাটা রূঢ় হলে্‌ও সত্য । এতো কোনো যান্ত্রিক পক্রিয়া নয় যে কবিতার ভাব ও রসের অভিজ্ঞতাটিকে ইলেকট্রিক করেন্টের মতো পাঠকের স্নায়ু তন্ত্রীতে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে! এর জন্যে পাঠকের কাব্য পাঠের উপযোগী অনুশীলনের প্রয়োজন। কারন আগের সে দিন নেই যে ভাবের ছলাকলা আর অলঙ্কারের, ছন্দের চাতুর্যে পাঠকের হদয় উদ্বেলিত হবে । যেহেতু যুগের সঙ্গে কবিতার অঙ্গিক বদলেছে, সেইসঙ্গে কেরিয়ারসর্বস্ব সমাজ ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে । ফলে পাঠকের বৃত্তটি গেছে আরো ছোট হয়ে ।বলতে গেলে কবিতার প্রয়োজন কি কমেছে, আজকের সমাজ বিবর্তনে ? ত হলে এই যে এত পত্রিকা এত কবিতা ? এসব কারা ? যারা লিখছে, কবিতা , শুধু কি তারাই এ ছোট বৃত্তের মধ্যে আছেন? মনে হয় তা সত্য নয় । কারন তা হলে প্রকৃত কবিতার, সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলির জন্ম হত না । এই প্রসঙ্গে কবি হুইটম্যানের একটি উক্তি স্মরনীয় : To have great Poets there must be great audiences too.
সুতরাং বাংলা ভাষাতেও কবিতার পাঠক আছে । এবং কবি ও পাঠকের এ বন্ধনকে শক্ত করতে উভয়কেই এগিয়ে আসতে হবে । না হলে এ মিলন সম্পূর্ণ হবে না ।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন “ বার বার ব্যর্থ হয়েও চেষ্টা করেছি সেই কবিতা লিখতে, নিজস্ব মহিমায় অম্লান থেকেও যা অনেক জনের কাছে পৌছাতে পারবে। কবি ও তাঁর পাঠককে যেখানে মেলানো যাবে।.........................পাঠক, আপনিও আপনার পোশাকি প্রত্যাশা এবারে বর্জন করুন। তা নইলে আমাদের মিলন সম্পূর্ন হবে না”।

দুপুরের পরিত্যক্ত প্রলাপ

দুপুরের পরিত্যক্ত প্রলাপ

স্মৃতির হাতে একটা দুটো পাখা
স্মৃতি বলে—‘যাই’
স্মৃতি বলে—‘মরনঝাঁপ যায় কি চেনা
একটা দুটো ফুলকি পেলে
মনের মতো ওড়াই’ ।



সেই দুপুর চিলেকোঠায় নেই
সেই দুপুর বুকের মাঝে
বুক ছোঁয়ালে
বুক জ্বলে যায়
বুক জ্বলে যায়
এত আগুন ।



আমি তোমার নাম জানিনা
আমি নেই তোমার জ্বরের কাছে,
মাথার পাশে,
পরিত্যক্ত তবু শুয়ে আছি
আজীবন তোমার পাপোষে ।



জলে ভেসে যায় শুকনো পাতা
জলে ভেসে যায় ২২শে শ্রাবণ
জলে ভেসে যায় “আয় সুখ”
জলে ভেসে যায় “যায় সুখ”
পথ ছাড়ো।



কে জানে কার চোখের ভিতর
কতখানি চোখ—
কে জানে কার শোকের ভিতর
কতখানি শোক,
আমি চোখ মেলে শোকের পাশে
শুয়ে আছি !



ফুটপাথের ন্যাংটো ছেলেদের রাজা ডেকে বলল
কি যে বলল—
ভাবতে ভাবতে মে দিবসের মিছিলের মতো বৃষ্টি এলো
দেখলুম সামনে দাঁড়িয়ে মেহের আলি
চিৎকার করছে—তফাৎ যাও— তফাৎ যাও



দুপুরের রোদে সব পুড়ে যায়
অধর—চোখ—চুমু—
বুক খানি থেকে গেলে
শুধু সে টুকুই মনে হয়—‘ছাইদানি’!



দিদি আসে দিদি যায়
ভাই গুলি তার রোদ
বোন গুলি তার মেঘ
এই রোদে এই মেঘে ভাসতে ভাসতে
কেন জানি মনে হয়
দিন বদলায় ।


কোন দিন মেলায় গিয়ে হারিয়ে গেলে বেশ হত
মনে লেখা হয়ে যেতো শুধু মুখ গুলি—শুধু মুখ গুলি ।

Saturday, December 4, 2010


 বৃষ্টি ডানা

ঝির ঝির বৃষ্টি ।বৃষ্টিপাতের সঙ্গে মিলেছে ঝিঝির ডাক সেই সঙ্গে তার মনোবিলাস ; কোথাও সমাপতনের মতো করে দু-একটা ইট ধসে পড়ে, দেওয়াল ধ্বসে পড়ে, এ সব কান পেতে শোনা না মনোবিভ্রম ? যা বঙ্কিম ভ্রু উঁচিয়ে দ্যাখে, মাথা নাড়ে, হাতপা নাড়ে তারপর ছায়ার দিকে সরে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ! তোড়া রাত্রে খেতেবসে এ সব ভাবে! একাই খেতে বসে, বাচ্ছাটাকে খাইয়ে দাইয়ে দিয়ে দোলায় শুইয়ে দেয় আগে তারপর সে রান্নাঘরে আসে। তার শ্বশুর মাঝে মাঝে দোলনায় একটু দোল দেয়, শশুড়ি ফিস্ ফিস্ করা কথা বলে –তোড়া রান্না ঘর থেকে আবছা শুনতে পায়—দেওয়ালের গা বেয়ে বেয়ে সে কথারা মাকড়সার মতো চলে বেড়ায়। প্রথম প্রথম তার ভয় করত, পোড়ো বাড়ির মতো বহু পুরানো বাড়ি—গলি ঘুঁজিতে থিক্ থিক্ জমে থাকা অন্ধকার—সেই অন্ধকারে কারা যেন হেঁটে বেড়ায়—এমনো মনে হতো তার, মনের ভিতর কিছু পরস্পর সংলগ্ন ভয়—দশ আঙুল মেলে মাকড়শার জাল বোনে—আর কথার খেই হারিয়ে গেলে শ্বাস বায়ুর অভিঘাতের মতো কথার অভিনয় করে চলে ক্রমাগত যেন আবছায়ার দিকে বসে কেউ খুক্ খুক্ কাশে ! সে বড় বিশ্রী ব্যাপার তখন একা একা খেতে বসা । শ্বশুর-শশুড়ি আগে খেয়ে নেয়—সামান্য যে টুকু তদের আ্হার ; তর অনেক পরে হ্যারিকেনের আলোয় দীর্ঘ ছায়া ফেলে সে যখন রান্না ঘরে আসে তখন গা ছম্ ছম্ করে । মনে হয় লাঠি হারিয়ে কোনো অন্ধ মানুষ যেন অবিরত হাতড়ে বেড়াচ্ছে ।
     কিন্তু এখন আর তেমন মনে হয় না বরং একা খেতে বসা একটা বিলাস—অনেক সময় নিয়ে, চার পাশে যেন অঢেল সময় হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকে ! সে ভাবে আকাশ পাতাল, ঝিঝির ডাক শোনে—শীতকাল বলে দূরে শেয়াল ডাকে, কুয়াশা হাতড়ে হাতড়ে সে ডাক যেন রান্না ঘরের দাওয়ায় এসে থমকে দাঁড়ায়; ভয়ের কথাই তা ! কিন্তু যার ভবিতব্য এভাবেই কোল পেতে বসে থাকে তার একদিন ভায় কাটে বইকি ! তোড়াও এতদিনে এদের সঙ্গে হতে হাত রেখে বসবাস করতে শিখে নিয়েছে !একটা বড় দা সে বাসনকোসনের মতো করে রান্না ঘরের তাকে সাজিয়ে রাখে, সেটা হাতে নিলে তার সারা গা শক্ত হয়ে যায়—বাইরের ঘরের জানালায় অকারনে যখন টোকা মারার শব্দ পায় তখন রান্না ঘরের মৃদু আলোয় তার ছায়া যেন আরো দীর্ঘ হয়ে যায়—নিবিড় অন্ধকারেরও যেন সীমানা ছাড়িয়ে যায়, ছায়ারাও সে সময় কানে ফুসমন্তর দেয়—যে বাড়িতে সমর্থ পুরুষ নেই সে বাড়ির কড়া বাতাসেও নড়ে ।
     তোড়ার কানে এই সকল শব্দ এখন নিমিত্তের মশা মাত্র, তারা ক্ষনিক গুন গুন শব্দ তুলে ফের অন্ধকারের দিকে মিলিয়ে যায়, মিলিয়ে যায় কেননা সে—তোড়া এই সমস্ত শব্দের প্রহার পরিহার করে আজকাল ! সে থাকে আহারের বিলাসে মগ্ন—দীর্ঘ ক্ষন; চর্বিত চর্বন তার নানাবিধ চিন্তা ঘুরে ফিরে নানা দৃষ্টিকোনের অনুপাতে দংশন করে যায় ! তবু সে ভাবনাগুলোকে কোলের কাছে জড়ো করে রাখে যেন এক মমতার খেলা চলে তাদের সাধে তার । পা ছড়িয়ে সে তাদের সঙ্গে বসে—মনে মনে দু-চারটে কথার ফুলকি ওড়ে, বাতাসে ভাসে, রংমশালের মতো কখনো তারা রঙিন, কখনো অন্ধকারে দু-একটা জোনাক জ্বলে—নেভে, অথবা পাশাপাশি তারা বসে থাকে তোড়ার আসে পাশে, কি ভীষন মায়া চিত্রন করে যেন তারা একাকী তোড়ার চারপশে অন্ধকার, চরাচরে !
     রাতের দিকে তোড়া বিশেষ রান্না করেনা—দুপুরের তরকারি গরম করে নেয়; আর দু-মুঠো ভাত নিজের জন্য ফুটিয়ে নেয় !
     ছেলেকে নিয়ে বিছানায় যেতে যেতে তোড়ার সেই রাত এগারোটা ! পুচকেটা ততক্ষনে ঘুমিয়ে কাদা ।
     ছেলেকে বিছানা ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে সে যখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল খুলে বসে তখন এক প্রবল ভার যেন তার সারা শরীরে নেমে আসে ! আবার চারপাশের ভাবনা গুলো প্রসাধনের মতো মাখতে থাকে সারা গায়ে—চুলে বিলি কাটে ।
     সুমিত ঘরে থাকলে সে এভাবে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল খুলে বসেত না—সে পায়চারি করে বেনী রচনা করত হেসে—“আমকে কেমন মানাচ্ছে বলো তো?”—কথায় আহ্লাদ দ্বি-প্রহরের রৌদ্রের মতো আভা দেয়—তার চোখের দ্যুতি প্রহারে অভিসিক্ত করে সুমিতকে ব্যতিব্যস্ত করে। সে সব খেলা বা বাতাসের স্বাভাবিক হিল্লোল—আজ তোড়ার মনে হয় নষ্ট পোকার মতো কুরে কুরে খায় ! কোথায় গাছের গাছের ডানায় মেঘ বৃষ্টি হয়ে মোমের মতো বিগলিত হয়ে নামে ? নামে আজো—তোড়ার বুকের ভিতর নিভৃতে কদাচিসুমিত এসে পড়লে ! কিন্তু এখন তোড়ার সারা গায়ে প্রবল ভার, যেন বর্ষার সমস্ত মেঘ পাহাড়ের মতো তার বুকে এসে জমেছে ।
     চুলে দুবার চিরুনি বুলিয়ে নিয়ে সে বসে ধাকে ঠায়—সেই রাত দুটো আড়াইটে  অবধি, “আয় ঘুম, আয় ঘুম” তার ঘুম আসেনা মোটে—মাধার ভিতর অনবরত  বিন্দু বিন্দু আগুনের স্ফূরন—তার প্রিয় গল্পের বই থেকেও বিরত করে তাকে; সে শরীরের বিপুল ভার নিয়ে উঠতে পারে না—স্থবীরতা তাকে বসিয়ে রাখে !
     কোনো কোনো দিন ছোট জা ফোন করে তাকে রাত্রের দিকে ! আগুনের ছিটে বর্ষায় যেন তার কানে—মাঝে মাজে তার অবাক লাগে—“ওরা ফোন করে কেন?অসময়ের অভিনয়কে কি প্রলম্বিত করার জন্যে?” কিংবা কিছুই না—অনন্য দুঃখের নির্মান সুখ !
     ছোট দেওর বড় অফিসার—সরকারি, তার কলকাতায় বাসাবাড়ি, গাড়ি, ঠাট, জমক অনবরত বিভেদের এক নোঙর সাজিয়ে রাখে—বলে—“তারা সব তোড়ার মাটির থেকে অনেক মাইল দূরে”।
     কখনো সখনো তারা গাড়ি হাঁকিয়ে দেশের বাড়িতে বেড়াতে আসে! যেন চার পাশে লক্ষ করে দেখে আগাছা কতো বড় হয়েছে !
     উপদেশের মতো করে তারা দুঃখ—টঃখ—ছাই—পাঁশ বর্ষন করে যায় !সে সময় শ্বশুর শাশুড়ি পর্ণোমোচী হয়ে যায়—রূপ বদল হয় তাদের হাবে ভাবে।
     সে কয়দিন তোড়ার সবকিছু নিঝুম মনে হয়—মনে হয় কোথাও একাকিত্বের দিকে অন্ধকার গাঢ় হয়ে গিয়েছে, মনে মনে বলে—“ভগবান আছেন , ভগবান আছেন” বাথরুমে যেতেও তার তখন ঘেন্না লাগে—সে বাথরুম তার দেওরের অর্থে বানানো, অথচ সুমিত কে বার বার বলেও “একটা বাথরুম বানিবে দাও, ভালো মন্দ যেমন তেমন”, সুরাহা দূর অস্ত, যেন সে কথা বারংবার দেওয়ালে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এসে মনোবেদনায় ক্লান্ত; তোড়া যদিও দিনের বেলা বাগানে যায়, কিন্তু রাত্রে সে বাগানে যেতে পারে না, ভুতের এক অলীক ভয়, বিছানায় কাঠ হয়ে সে পড়ে থাকে—ঘরের বাথরুমেও যায় না।
     সুমিত কারখানায় কাজ কারে, ছোট মোট কাজ, আসলে তার কাজের ইচ্চেটাই কম, শুধু তার বড় বড় কাথার ফানুস, তাইতেই সে আকাশে ভাসে—অন্যায় তর্কের প্রাচীর তুলে চোখ লাল, মুখ ভঙ্গিল, খাঁ খাঁ মাঠে রৌদ্দুরের প্রদাহের মতো তার কথা অসহ্য ! তোড়া তর্ক করে না, অবস্য তর্কের অভিলাষ তার কোনদিনই ছিল না, ছোট থেকেই সে শান্ত “বুক ফাটে তো মুখ ফোতে না” যদিও তার ভাবনা বা সিদ্ধান্ত অটল তাতেই চিরটাকাল সে একটা একলাটে, মেলামেশায় সে বসে বসে কথা শোনে, ঠোটের কোনে কোনে হাসে; এটুকুই, ভিতরের কথা তার বাইরে আসে না !
     বিয়েটা তাদের দেখাশুনা করেই, সুমিতও দেখতে গিয়েছিল, তার সম্মতিক্রমেই বিবাহ; তবু ফুলশয্যার প্রথম নৈকট্যে তোড়া বোধ হয় বুঝেছিল সুমিতের মনে কোথাও একটা অপচ্ছন্দের কাঁটা রয়ে গেছে ! আসলে সুমিতের পছন্দতাই কিংবা পছন্দ অপছন্দের বোধ বুদবুদের মতো, রোদে রামধনু রচনা করে নিমেশে ফুড়ু! সেই থেকেই তোড়া যেন এক কাঁটার ঝোপ সর্বদা কোলের কাছে নিয়ে ঘর করে—বসবাস করে ।ঘরের ভিতরে তার আগাছা বাড়ে কাঁটাঝোপের , বাইরে থাকে অলীক দেওয়াল।
আগাছা সব সুমিতের খেয়াল, বাদবিচার, তোড়া সেই খেয়ালের ঘুড়ির সাথে লেজের মতো জড়িয়ে মড়িয়ে একসা ।
     সুমিত আসলে তার মায়ের মতো, তোড়ার শাশুড়ি কথা বলে বেশ, কিন্তু কথার ভিতর হুল, হুলে বিষ জ্বালা !
     তোড়ার সবই আস্তে আস্তে থিতিয়ে যেতো , সয়ে যেতো হয়ত, পুচকেটা আসার পরে! তোড়া তেমনই আশার স্বপ্নে মগ্ন ছিল ! কিন্তু কোথা থেকে মাঝে মাঝে কিছু উড়ো হাওয়া এসে সে মগ্নতা কাচের মতো ভেঙে দিয়ে যায় ! তোড়া নড়ে চড়ে বসার অবসর পায় না, তার সারা দে্হ পাথরের মতো ভারি হয়ে যায় ।
     তোড়া তার সুদীর্ঘ চুলের ছায়া আয়নায়—অন্ধকারের আবছায়ায় প্রতিফলিত হতে দেখে ক্ষনিক শান্তি পায়—এই চুল খুলে আয়নার সামনে বসা—এ এক বিলাস তার, সেই বয়ঃসন্ধিকাল থেকে; যবে থেকে সে আয়নাকে বুঝতে শিখেছে, বুঝতে শিখেছে তার টিকালো নাসা, মুখের লাবন্য ও দীর্ঘ চুলের বিন্যাস , সেই উড়ো মেঘের বয়স থেকেই তার পড়াশুনা ছেড়ে আয়নার সামনে বসে থাকা এক আহ্লাদ, তবু তোড়া সুন্দরী নয় প্রকৃত অর্থে, তা হলেও এক লাবন্যের দ্যুতি প্রতিমার মুকে গর্জন তেলের মতো করে মাখানো—চোখে পড়ে , একটু মনোযোগে তাকালেই হল ! তোড়া সুমিতের চোখে সে মনোযোজ দেখে না !
     আজ সেই চুলও তার মনোবেদনার সঙ্গে মিশে ম্লান—প্রানহীন! খুব উঠে যাচ্ছে ইদানীং ! সুমিতকে সে বলেছে “জানো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, চুল উঠছে খুব!” সুমিত আজ নয়, কাল নয় করে হাওয়ায় ভাসিবে রেখেছে সবকিছু ।
     ইদানীং শুনেছে সুমিত কারখানার কাজ ও ছেড়েছে, ছেড়ে কি করছে তোড়া তা জানে না—তোড়াকে সে কিছু জানায়নি, জানাবার কোনো প্রয়োজন সে তার কথাতে হাসিতে প্রাকাশ করার অভিলাষ জ্ঞাপন করেনি, সুমিত নিজের ভিতরেই নিজে চিত্রিত করে নিয়েছে নিজের দিনযাপন ।
তোড়া এখন তার চোখের কাঁকর, অনবরত কর্ কর্ করে; অবিরত বিদ্বেষ ঢেলে চলে, তার ব্যবহারে; তোড়ার মনে হয় শুধু চোরের মতো সর্বদা অস্থির, চঞ্চল, মাছির মতো উড়ে উড়ে শুধু বিরক্ত করে।
পুচকেটাকেও কাছে টানে না, তোড়ার কোনো গভীর আকুতি “ওগো ছেলেকে দ্যাখো” যেন বন্ধ দেওয়ালে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে ফিরে আসে! অথচ তোড়ার শরীরে গোপন ভাঁজ—গভীর অন্দরের ভিতর সেঁদিয়ে যেতে সুমিতের উল্লাস বাধাহীন, তা কাঠ ঠোকরার মতো আহ্লাদে ঠুকরে যায়, আসলে চিরদিনই শরীরে তার অভিনিবেশ, তোড়ার শরীরও শুধু সেই পারস্পরিক প্রয়োজনের ভাস্কর্য যদিও তা শিল্পির কিংবা নির্মানের নয়, ভাঙনের; তোড়ার কোনো “এখন নয়” শোনে না, নদীর মতো এক পাড় ভাঙে, তোড়া তলিয়ে যেতে যেতে অভিমানের হিক্কার তোলে—“নাও, খাও খাও”!
     তোড়ার ভয় ছিল মাসের ঠিক সময় নয় সেটা; সেই বাসাবাঁধা ভয় একদিন প্রবল মনে হল,পিরিয়ড পিছিয়ে যেতে! তোড়া সে ভয়ের কথা কাকে বলবে?আসলে সুমিত আর চায় না, তাই ভয়! তাই ভয় ফনিমনসার ঝোপের ভিতর আটকে থাকার মতো শত্রুতা; এ ভাবে এই ভয়ের খেউড় শুনতে শুনতে দিন পেরিয়ে যায় বেশ কিছু।
শেষে যখন শরিরের ভিতর এক নদীর কল্ কল্ প্রবাহ—হাসি টের পায় তোড়া তখন সে সুমিত কে বলে;
সুমিতের এতো রাগ কখনো দেখেনি সে। সুমিত অনবরত ঝড়ের মতো ভেঙে পড়ে যেন তোড়ার উপর; সেই প্রথম সুমিত তোড়ার গায়ে হত তোলে।
     সুমিত ডাক্তারের কাছে যেতে চায়, কিন্তু তোড়া রাজি নয়, সুমিত মারধোর করে, রাগ করে, কিন্তু তোড়া অনড়; সে আরো বাঁধনে জড়াতে চায় সুমিতকে!কোথায় যাবে সে তোড়ার হাত ছাড়িয়ে? তোড়া তা হতে দিতে পারে না, যতই অধিকারের দেওয়ালগুলো ভেঙে পড়ুক; আর একটা প্রান স্পন্দন দিয়ে সে নিশ্চই সুমিতকে আগলে রাখতে পারবে! তাছাড়া কোথায় যাবে তোড়া?বাবার অবস্থা তেমন ভালো না—দুটো বোন আছে; তোড়াকে তাই এখানেই থাকতে হবে, ভালোবাসার নাম করে মিথ্যেকে বাঁচিবে রাখতে হবে ! তোড়া সেই স্বপ্নের আশায় থাকে—কখনো ভয় মাতব্বরি করে,তাসের ঘরের মতো ভেঙে দিতে চায় সবকিছু—সেই মাতব্বর ভয়ই ফুসমন্তর দেয় “তুমি না পেলে কিছু, সুমিতও কেন কিছু পাবে?”
     সেই ভয়ই এখন আয়নার সামনে বসে অন্ধকারে অভয় দেয়, আস্কারা দেয় তোড়াকে, পাথরের মতো চাপ চাপ সে আস্কারা—“সুমিত কিছু পাবে না, না পেলে.....”!
     তোড়া মুচকি মুচকি হাসে, তখন তার চুলে মুখের এক পাশে জানালা দিয়ে চাঁদের আলোর একটা টুকরো এসে পড়েছে!মেঘর ফাঁক দিয়ে একটুখানি ভাঙা চাঁদ—এখনি হয়ত মেঘে ঢেকে যাবে, বৃষ্টি নামবে, বৃষ্টি নামলে তোড়া গাছেদের পাহারা বাঁচিয়ে পরকীয়ায় মাতবে—সে ও তার মেঘ, তার দু হাতে বৃষ্টি ডানা , তোড়া আবার হাসে, শব্দ করে হাসে “পরকীয়াতে দোষ আর কি? সুমিত করছে যখন”! খবরটা কানাঘুষোয় শুনেছিল, আজ ভালো লোকের কাছ থেকেই খবর পেয়েছে, সুমিত আবার বিয়ে করতে চায় !ছোট জা ফোনে হাসতে হাসতে বল্ল “মরন, গলায় দড়ি জোটে না!”
     তোড়া আবার একটু হাসে, আয়নাতে নিজেকে এলো চুলে দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যায়, চোক ফেরাতে পারে না! তোড়া আয়নার ভিতর এক অচেনা মেয়ের প্রচ্ছায়া খুঁজতে খুঁজতে হাঁপিয়ে মরে, সুমিতের সঙ্গে তাকে কেমন মানাবে?
     হাসতে হাসতে বলে “কেমন?”
ভিতর থেকে মাতব্বর ভায় বলে “সুমিত কে যেতে দেবে?”
তোড়া মনে মনে বলে “যাক্” , এই বলে সে ভয়কেও মুক্তি দেয় তার ভিতর থেকে !
     সে নীচে থেকে শ্বশুরের ঘুমের বড়ির শিশিটা এনে রেখেছে, ভেবেছিল কাল সুমিত আসবে, তখন তোড়া দেখবে সে কি করে যায় তোড়ার হআত ছাড়িয়ে!
     তোড়ার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে ! তার মেঘ আছে, দুই ডানা বৃষ্টি আছে, সে বৃষ্টি হয়ে ঠিক মেঘেদের ভিতর ঢুকে যাবে; ভাবতে ভাবতেই তোড়ার গায়ে কাঁটা দেয়, তা কি আনন্দ না বিষাদ ! তোড়া পুচকেটাকে মগ্ন হয়ে দেখতে দেখতে, আরো অনেক্ষন দেখতে দেখতে, আকাশ পাতাল ভাবে, ভাবতে ভাবতে আলগোছে শিশিটার দিকে হাত বাড়ায় !
     বাইরে তখন দু চার ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে ।

                          
                          ----শেষ----